গল্প | উড়ান মেঘের দেশে - পর্ব-১৭ | Oran megher deshe - Part-17

লেখিকা-ওয়াসিকা নুযহাত 


আজ থেকে শুরু করে টানা সাত দিন রাত দশটা থেকে সকাল ছয়টা পর্যন্ত কারফিউ চলবে। স্থানীয় লোকজন বলেছে গভীর রাতে জঙ্গলে নীল চোখ বিশিষ্ট এক  কিম্ভুতকিমাকার জন্তুকে ঘুরে বেড়াতে দেখা যায়।

সেই জন্তু কদিন আগে মধ্যরাতে রাজপথের এক ভিক্ষুকের ওপর হামলা চালিয়েছিল। সিসি ক্যামেরার ফুটেজে যতটা  বোঝা গেছে তাতে মনে হয়েছে এটি সাধারণ  কোনো প্রাণী নয়। সমুদ্রতীরবর্তি  গ্রামগুলোতে গত তিনদিনে নিখোঁজ হয়েছে সাতজন ব্যক্তি। এছাড়াও গতরাতে প্রাসাদ সংলগ্ন জঙ্গল থেকে একটি লাশ উদ্ধার করা হয়েছে। লাশটির শরীর থেকে ধড় বিচ্ছিন্ন ছিল এবং শরীরের নানা জায়গায় ছিল ধারালো দাঁতের সুগভীর ক্ষতচিহ্ন। ধারণা করা হচ্ছে এই মৃত্যু রহস্যের পেছনে উল্লিখিত হিংস্র জন্তুটিই দায়ী। তুর্যয় খবরটা শুনতে পেলো বেলা তিনটার দিকে। কলেজের সংবর্ধনা অনুষ্ঠান শেষে প্রেস কনফারেন্সের উদ্দেশ্যে যাত্রা শুরু করেছে মাত্র। তার সাথে আছে প্রধানমন্ত্রী জাফরের মেয়ে রিয়া। রিয়া তার স্কুল জীবনের বন্ধু। কলেজেও একই সাথেই পড়াশোনা করেছে। তাই কলেজের অনুষ্ঠানে রিয়া তার সঙ্গী হবে এই ঘটনা ছিল অবশ্যম্ভাবী। তুর্যয় মনস্থির করেছিল আজকের দিনে গরীব ছাত্র ছাত্রিদের জন্য বিশেষ অনুদানের ঘোষণা দেবে। কিন্তু কলেজে আসার পর জানতে পারল তার মেজো ভাই অজয় এর মাঝেই বেশ কিছু স্কলারশিপের ব্যবস্থা করেছে রাজ্যের সুবিধাবঞ্ছিত শিক্ষার্থিদের জন্য। ক্রীড়া সংগঠন গুলোতেও তার মোটা অঙ্কের অনুদান  আছে।  এই তথ্য তুর্যয়কে আনন্দিত এবং গর্বিত করেছে। কিন্তু নীল চোখ ওয়ালা অদ্ভুত জন্তুর খবর  তার বিজ্ঞানমনস্ক মন সহজ ভাবে নিতে পারছে না।  তার ধারণা সমুদ্রকুঞ্জের জনগণ সব কিছুকে  ফ্যান্টাসাইজ করতে ভালোবাসে। সাংবাদিকরা পত্রপত্রিকায় জন্তুটি সম্পর্কে এমন ইনিয়ে বিনিয়ে লিখেছে যেন কোনও সাধারণ বন্য জন্তু নয়, জম্বি, ডায়নোসার কিংবা আলাদীনের দৈত্য এসে হাজির হয়েছে সমুদ্রকুঞ্জে। রাজ্যের সাংবাদিকদের ওপরে এমনিতেই সে ত্যাক্ত বিরক্ত। কমনসেন্স বলতে কিছু  নেই এদের। একটু আগে কলেজে ঢোকার মুখে রিয়াকে তার পাশে  দেখে একজন মাথামোটা বেকুব সাংবাদিক প্রশ্ন ছুঁড়ে দিয়েছে, ‘আপনাদের  বিয়েটা কি এ বছরেই হচ্ছে?’ 


তুর্যয় রাগের ঠ্যালায় এই স্টুপিড প্রশ্নের কোনও উত্তর দিতে পারেনি। কিন্তু রিয়াকে বলতে শুনেছে, ‘এখনও ডেট ফিক্স হয়নি।’ 


রিয়ার কথাটা তাকে বিস্মিত করেছে। ওর সাথে বন্ধুত্বটা বেশ জমানো। কিন্তু মনের আদান প্রদান তো কখনও হয়নি! বিয়ের কথা আসছে কেন? 


লিমোজিন গাড়িটা দশ নম্বর এভিনিউর তিন লেন বিশিষ্ট চওড়া রাস্তা দিয়ে মসৃণ গতিতে এগিয়ে যাচ্ছিল। এই রাস্তার দুপাশে সব সারিবাঁধা অফিস বিল্ডিং। আধুনিক স্থাপত্য নয় একটাও। সবগুলো দালানে ভিক্টোরিয়া যুগের সুস্পষ্ট ছাপ। রাজ্যের সম্ভাব্য  যুবরাজের বাহন যাতায়াত করছে বিধায় এই সড়কটি এখন সাধারণ জনগণের জন্য অবরুদ্ধ করা হয়েছে। তুর্যয়ের লিমোজিনের সামনে এবং পিছনে দুটো লাল নীল বাতি জ্বালানো পুলিশি গাড়ি রয়েছে।  রাস্তাঘাট একদম ফাঁকা। তুর্যয়ের মনে হচ্ছে রাস্তা অবরুদ্ধ করার কারণে সে নিত্যদিনের স্বাভাবিক রাজধানীর দৃশ্য অবলোকন করা থেকে বঞ্ছিত হচ্ছে। তাছাড়া সাধারণ জনগণের জন্যও এটা চরম ভোগান্তির ব্যাপার। শহরের মূল সড়ক বন্ধ থাকলে অন্যান্য রাস্তা গুলোর ওপর চাপ পড়ে। যানজট সৃষ্টি হয়। প্রতিটি মানুষের সময়ের মূল্য আছে। সে ঠিক করল এই ব্যাপারে প্রধানমন্ত্রীর সাথে কথা বলবে। এরপর থেকে আর কখনো যেন রাজকীয়দের যাতায়াতের জন্য রাস্তা অবরুদ্ধ করা না হয়। আর দশটা মানুষের মতো নিজের দেশের রাস্তায় সাধারণ ভাবে চলাফেরা করতে চায় সে। যুবরাজ হিসেবে কোনও বিশেষাধিকার  চাই না তার।   


উল্টো পাশের গদিতে রিয়া বসে আছে। তার পরনে একটা লাল রঙের হাঁটু ছোঁয়া জামা। হাই হিল জুতো। দামি পারফিউমের গন্ধে ভুর ভুর করছে বদ্ধ কম্পার্টমেন্টের থমকানো বাতাস। তুর্যয় জানালার বাইরে চোখ রেখেছিল। তার কপালে বিরক্তিসূচক হালকা কুঞ্চন। রিয়া বলল, 


-’তুই কি কোনও কারণে ডিস্টার্বড?’ 


তুর্যয় চোখ ঘুরিয়ে আনল রিয়ার মুখে ওপর, ‘কিছুটা।’ 


-’কেন?’ 


-’আমি যাতায়াত করছি  বলে কোনও সাধারণ মানুষ এই রোড ইউজ করতে পারবে না কেন? এটা অন্যায়।’ 


রিয়া একটু হাসি  হাসি গলায় বলল, ‘আমার তো বেশ ভালো লাগছে। দ্যাখ না রাস্তাটা একদম ফাঁকা! কোনও সিগ্ন্যালও পড়ছে না। এরকম রাস্তায় চলতে দারুণ ভালো লাগে!’ 


-’তুই সাংবাদিককে এরকম উত্তর দিলি কেন? ‘ 


-’কী রকম?’ 


-’দ্যাখ রিয়া, তুই আমার খুব ভালো বন্ধু। বন্ধুর  বাইরে তোকে আমি কখনও কিছু ভাবিনি। তুই বুদ্ধিমতি মেয়ে। আমার বিশ্বাস তুই আমাকে বুঝবি।’ 


রিয়া হাসতে হাসতে বলল, ‘কেন আমাকে বিয়ে করতে তোর সমস্যা কোথায়? আমার মনে হয় আমাদের প্যারেন্টসরা এরকমই চায়। দেশের মানুষও এটা চায়।' 


রিয়া একটু থেমে আবার বলল, ‘দ্যাখ তুই যদি ভাবিস আমি তোকে ক্ষমতার লোভে বিয়ে করতে চাইছি তাহলে বলব তোর ধারণা একদম ভুল। আমার মনে হয় আমাদের বন্ধুত্ব এতটাই মজবুত যে আমরা চাইলেই নিজদের মধ্যে খুব সুন্দর একটা দাম্পত্য সম্পর্ক গড়তে পারব।' 


তুর্যয় ঘন কালো ভ্রুজোড়া উঁচিয়ে তাকাল রিয়ার দিকে। এই মেয়ের কথাবার্তা তার ঠিক বোধগম্য হচ্ছে না। বিরক্তির মাত্রাটা উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পাচ্ছে। এমনকি প্রেস কনফারেন্সেও এখন আর যেতে ইচ্ছে হচ্ছে না। সাংবাদিকদের বিরক্তিকর প্রশ্নের সম্মুখীন হতে হতে এর মাঝেই সে ক্লান্ত। জানালায় চোখ সরিয়ে নিতেই হঠাৎ তার সামনে একটি চেনা মুখ ভেসে উঠল। টনটন করে উঠল বুকের ভেতরটা। তার ইচ্ছে হলো এখুনি সব কাজ ফেলে রেখে নিজ মহলে ফিরে যেতে। আচ্ছা, মেহেরু এই ভর দুপুরবেলা অফিসে বসে কী করছে? কী ভাবছে? তুর্যয়ের জন্য অপেক্ষা করছে কি মনে মনে?   


কে জানে! 


 


----------------


রানিমা ডাক পাঠিয়েছিলেন খানিক আগে। কথাবার্তার ধরণ দেখে মনে হয়েছে মেহেরুর ওপর তিনি কোনও কারণে অসন্তুষ্ট। দেখামাত্র খটোমটো গলায় বললেন, 


-’ব্রাম্মণ ভোজের সময় তোমায় পাওয়া গেলো না। ছিলে কোথায়?’ 


-’রাজকুমারের অফিসে। ' 


-’ওই অফিসে তোমার কাজটা কী?’  কফির মগে চুমুক দেবার আগে প্রশ্নটা ছুঁড়ে দিলেন উর্মিলা। 


মেহেরুর বুক কাঁপতে লাগল দুরদুর করে। অতিশয় ক্ষীণ গলায় বলল, ‘এখনও সঠিক জানি না।’ 


উর্মিলা পাশে দাঁড়ানো দাসির হাতে কফির মগটা তুলে দিয়ে বললেন, ‘এটা নিয়ে এখান থেকে সরে পড়। কেউ যেন বিরক্ত না করে এই মূহুর্তে।’ 


দাসীটি কফির মগ হাতে নিয়ে প্রস্থান করল। রানিমা নিজ কক্ষের পালঙ্ক ঘেঁষা রৌপ্যখচিত সুপ্রশস্ত আসনে বসে আছেন। মাথার ওপর একটা বিশাল আকৃতির তিন ডানা ওয়ালা ফ্যান ঘুরছে। মেহেরু তাঁর সামনে নত মস্তকে দাঁড়িয়ে আছে। ফ্যানের বাতাসে কপালের চুল উড়ছে এলোমেলো। উর্মিলা একটূ কেশে নিয়ে ভারী গলায় বললেন, ‘তোমার বয়স কত হলো?’ 


বয়সের কথা উঠলে আজকাল মনটা খুব ছোট হয়ে যায়। এসব বিষয় এড়িয়ে যাবার জন্য আত্মীয়স্বজনদের সাথে মেহেরুর সম্পর্ক এখন বিলুপ্তির পথে। কর্মস্থানেও যে এসব বিব্রতকর বিষয় নিয়ে কথা বলতে হবে এটা জানা ছিল না। সে একটা দীর্ঘশ্বাস গোপন করল। নিচু স্বরে বলল, ‘তিরিশ হয়েছে গতমাসে।’  


-’তিরিশ! এই বয়সে আমি দুই সন্তানের জননী ছিলাম। জানো?’  


-’জি।’ 


-’আমার মনে হয় তোমার বিয়ের বয়স পেরিয়ে যাচ্ছে। আমি ঠিক করেছি তোমার একটা বিয়ে দেব।’ 


তীক্ষ্ণমুখ বর্শার ধারালো খোঁচা এসে লাগল বুকে। চমকে তাকালো মেহেরু উর্মিলার দিকে। উর্মিলা শান্ত গলায় বললেন, ‘এত অবাক হচ্ছ কেন? বিয়ে শাদি করবে না নাকি?’ 


-’না মানে   ...আসলে বাবা চলে যাবার পর থেকে সংসারের দায়িত্ব পুরোটাই আমার ঘাড়ে। তাই বিয়ের কথা আপাতত ভাবছি না।’ 


-’তোমার ভাবতে হবে না। তুমি তোমার মাকে একবার আমার সাথে দেখা করতে বলো। তোমার বাবা রাজবাড়ির সম্মানিত শিক্ষক ছিলেন। তাঁর পরিবারের প্রতি আমাদেরও তো কিছু দায়িত্ব আছে তাই না?’ 


মেহেরু চুপ করে রইল। উর্মিলা বললেন, 


-’আরেকটা বিষয়। বিয়ের পর তোমার আর রাজবাড়িতে চাকরি করতে হবে না। এমন লোকের সাথে তোমার বিয়ে হবে যে তোমার পুরো পরিবারকেই বহন করতে পারবে। বুঝতে পারছ?’ 


-’জি।’ 


-’আমি চাই তুমি খুব দ্রুত বিয়ে থা করে সংসারি হও।’ 


-’জি।’ 


-’এখন যাও। তোমার মাকে কাল বিকেলে একবার নিয়ে এসো আমার কাছে।’ 


  

বুকের মধ্যে দুঃসহ ভীতির ঝংকার নিয়ে অফিসে ফিরে এসেছে মেহেরু। অফিসে আরও পাঁচ ছয়জন কর্মচারি আছে। এরা প্রত্যেকে আজকেই জয়েন করেছে। সবার হাতে হাতে ঘুরছে জব ডেস্ক্রিপশন। একমাত্র মেহেরুর হাতেই চাকরির প্রথমদিন কোনও জব ডেস্ক্রিপশন নেই। সহকর্মিদের কাউকেই মেহেরু চেনে না। বয়স তার ধারে কাছেই হবে। তবুও কারো সাথে সহজ ভাবে মিশতে পারছে না। আড়ষ্টতায় জমে আছে ভেতরটা। এই আড়ষ্টতার কারণ অস্পষ্ট নয়, বরং স্পষ্টতর ভাবেই প্রতীয়মান। এই ছোট দলটার মধ্যে সবচেয়ে স্বল্প যোগ্যতাসম্পন্ন কর্মচারি হলো সে নিজে। এদের প্রত্যেকের ঝুলিতে আছে দামি ডিগ্রি এবং বিশ্বের খ্যাতিমান সব জায়গায় কাজ করার অভিজ্ঞতা। ইয়ানা নামের একটি মেয়ে ভারতের আই আই টি থেকে ইঞ্জিনিয়ারিং পাশ করে তুর্যয়ের সাথেই ক্যাম্ব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ে ইলেক্ট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং এ পিএইচডি করেছে। মেয়েটি লেখাপড়ায় তুখোড়। কী ভীষণ স্মার্ট! তাকালেই বুদ্ধির ঝিলিকে একদম চোখে ধাঁধা লেগে যায়। মনের মধ্যে আপনাআপনিই সম্মান তৈরি হয়। শুধু এই মেয়েটিই নয়, বাকিদের অ্যাকাডেমিক ব্যাকগ্রাউন্ডও হাইপ্রোফাইল। একমাত্র মেহেরুই এখানে উচ্চ মাধ্যমিক পাশ। তার মনটা তাই প্রথম থেকেই বেশ  সংকুচিত  হয়ে আছে। একটু আগে লাঞ্চ টেবিলে কলিগরা সবাই যার যার শিক্ষাগত যোগ্যতা এবং অভিজ্ঞতা নিয়ে কথা বলছিল। মেহেরুর কিছু বলার নেই। বেলুনের মতো চুপসে যাওয়া মুখ নিয়ে নির্বাক বসে আছে। জীবনে যেখানেই গিয়েছে লোকে ঘুরেফিরে তার রুপের প্রশংসা করেছে। এই একটা মাত্র জায়গায় এসে সে আবিষ্কার করেছে, মানুষের বাহ্যিক সৌন্দর্য এবং সাংসারিক টানাপড়েন আসলে গুরুত্বপূর্ণ কোনও বিষয়ই না। আরও কত কী নিয়ে কথা বলার আছে! আজকের পৃথিবীতে রুপের চেয়ে গুণের দাম অনেক বেশি। গুণের জোরেই মানুষ এখন রুপের অধিকারী হয়। গুণবিহীন সুন্দর চেহারা আর মাকাল ফলের মধ্যে কোনও তফাৎ নেই। মেহেরু চুপ করে ওদের কথা শুনছিল। এর মাঝেই সঞ্জিব নামের একটি ছিপছিপে চেহারার ছেলে, বয়স  তিরিশের আশেপাশে হবে হয়তো, মেহেরুর দিকে তাকিয়ে খুব বিনয়ী ভঙ্গিতে প্রশ্ন করল, ‘আপু আপনি কোথায় পড়াশোনা করেছেন?’ 


প্রশ্নটা শুনতে পাওয়া মাত্র মেহেরুর চন্দন রঙের মসৃণ ত্বকের ভাঁজে ভাঁজে কৃষ্ণ মেঘের ছায়া পড়ল। মুখের মধ্যে রুটির টুকরো ছিল। মুহুর্তের জন্য সে রুটিটা চিবোতে ভুলে গেলো। উপস্থিত সকলে তার দিকে চেয়ে আছে উত্তরের প্রত্যাশায়। সে নার্ভাস বোধ করছে। বলার মতো শব্দ খুঁজে পাচ্ছে না।  সামনে যারা বসে আছে এদের প্রত্যেককেই হাজার হাজার দরখাস্ত থেকে যাচাই বাছাই করে নিয়োগ দেয়া হয়েছে। যুবরাজের কার্যালয় পর্যন্ত পৌঁছুতে এদেরকে করতে হয়েছে রক্ত জল করা পরিশ্রম। সে জায়গায় মেহেরু কোনও যোগ্যতা ছাড়াই রাজ্যের সর্বোচ্চ সম্মানিত দপ্তরে কাজের সুযোগ পেয়ে গেছে, ঘটনাটা জানার পর এই সুশীল শিক্ষিতদের প্রতিক্রিয়া কী হবে? 


মেহেরু মুখের খাবারটুকু গিলে নিয়ে এক গ্লাস পানি পান করল ধীরে সুস্থে। তারপর চোখ নিচের দিকে নামিয়ে ক্ষীণ গলায় বলল, ‘আমার এইচ এস সি’ র পর আর পড়াশোনা করার সুযোগ হয়নি।’ 


ঘরের বাতাস হঠাৎ একটুখানি সময়ের জন্য থমকে গেলো। প্রশ্নকর্তা নিজেই বেশ বিব্রত হয়ে পড়েছে। অপ্রস্তুত ভাবে একবার বলল, ‘ও আচ্ছা!’ 


মেহেরু আর কোনও শব্দ উচ্চারণ না করে চুপচাপ খেতে লাগল। মন ভয়াবহ রকমের খারাপ! তুর্যয়ের জিদ এবং একগুঁয়েমির কারণেই আজকে তাকে এতগুলো মানুষের সামনে অপমানিত হতে হলো। রানিমার চোখেও আজ সে সন্দেহ এবং অবিশ্বাস মিশ্রিত চাপা উদ্বেগ প্রত্যক্ষ করেছে। হঠাৎ তার  বিয়ে নিয়ে তিনি উঠে পড়ে লাগলেন কেন সে এক রহস্য। অথচ মেহেরু এখন কেন, কোনদিনই বিয়ে করতে পারবে না। রানিমার কানে এই সংবাদ দেয়া যাবে না।  রাজপরিবারের সাথে জাদু জানা লোকজনদের একটা অমীমাংসিত বিরোধ চলে আসছে বহুদিন ধরে। মেহেরু এই বিষয়ে খুব বিস্তারিত জানে না, কিন্তু বাবা মারা যাবার আগে খুব গোপনে তাকে বলেছিল,  ‘মারে, তুই যে একটু আকটু মন্ত্র টন্ত্র পারিস এ কথা  ভুলেও কখনও রাজবাড়ির কোনও সদস্যকে জানাবি না। বিষয়টা সর্বদা গোপন রাখবি।'


নিজের জন্মদায়ক পিতামাতাকে দেখার  সৌভাগ্য কখনও হয়নি তার। পালক পিতামাতাকেই জীবনের চাইতে বেশি ভালবেসেছে। আর এই পালক মাতাকে  একবার প্রাণে বাঁচাতে গিয়ে জাদুর প্রয়োগ করতে হয়েছিল। জীবনের সবচেয়ে কঠিন জাদু! যত বড় জাদুকরই তুমি হও না কেন বিশেষ জাদু গুলো মূল্যহীন ভাবে ধরা দেবে না। মেহেরুকে মায়ের আয়ু কিনতে হয়েছিল মূল্যবান  বস্তুর বিনিময়ে।  সেই থেকে একটি অভিশপ্ত দায়বদ্ধতা এসে ভিড়েছিল তার জীবনে। সেই দায়বদ্ধতার সাথে জড়িয়ে দেয়া হয়েছিল তার প্রথম ভূমিষ্ট সন্তানকে। যে এখনও পৃথিবীর আলো দেখেনি, সেই নিষ্পাপ প্রাণকে নিয়েই চুক্তিবদ্ধ হতে হয়েছিল নিরুপায় হয়ে। আর এ কারণেই মেহেরু চায় না, তার সন্তান কখনও পৃথিবীতে আসুক। নিজ সন্তানকে নরকের আগুনে জ্বলে পুড়ে নিঃশেষ হতে দেখার চাইতে, একটি জীবন অবিবাহিতা অবস্থায় নিঃসঙ্গ কাটিয়ে দেয়াই অধিকতর উত্তম এবং সহজ। 


ডেস্কের পিসিতে চোখ রেখে চুপচাপ বসে ছিল সে। চোখের কার্নিশে একটু জলের ছায়া পড়েছিল। সেই ছায়া ঢাকার জন্য রোদ চশমা লাগাতে হয়েছে। উপস্থিত মানুষগুলো অবশ্য কেউই তার দিকে তাকিয়ে নেই। সবাই যার যার কাজে ব্যস্ত। তবুও রোদ চশমা লাগিয়ে নিজেকেই যেন নিজের কাছ থেকে আড়াল করল। তুর্যয়ের সাথে আজকেই কথা বলতে হবে। ওকে বুঝতে হবে মেহেরু এই কার্যালয়ের জন্য অযোগ্য এবং বেমানান। সে ঠিক করল আজই  চাকরিতে ইস্তফা দেবে। ঘড়িতে এখন সন্ধ্যে ছটা। তুর্যয় কখন আসবে কে জানে! সময় যে কাটছে না! 


অফিস ঘর থেকে বেরিয়ে এসে মহল সংলগ্ন চত্বরে পায়চারি করা শুরু করল। মনের মধ্যে একটা একঘেয়ে তিতকুটে ভাব দাঁত কামড়ে পড়ে আছে। তার জীবনটায় সত্যি কোনও আনন্দ নেই! এই নিরানন্দ ভাবটার মূল কারণ হচ্ছে স্বপ্ন দেখতে পারার অপারগতা। অনেকদিন হয় নিজেকে নিয়ে সে কোনও স্বপ্ন দেখে না। ভবিষ্যতের কথা মাথায় এলেই কেবল পুঁথি পড়ার মতো মনে মনে একটা বাক্য আওড়ায়,  মিথিলার ডিগ্রিটা হয়ে গেলেই আমরা সমুদ্রকুঞ্জ ছেড়ে চলে যাব। শেষ হয়ে আসবে দুঃখের দিন। এই একটি মাত্র উদ্দেশ্য হাসিলের জন্যই যেন তার হৃদযন্ত্রটা প্রতি সেকেন্ডে স্পন্দিত হয়ে ধমনীতে রক্ত সঞ্চালন করছে। এর বাইরে তার বেঁচে থাকার আর কোনও  অভিসন্ধি নেই। এদিকে রাশিকার খবর পাওয়া যায়নি এখনো। মেয়েটি লাপাত্তা। মেহেরু কোনও লোকেটর স্পেল জানে না। তার চাচা মশাই জানে। সে ঠিক করল আজ কালের মধ্যে একবার চাচা মশাইয়ের কাছে যাবে। মেয়েটির খোঁজ পাওয়া অতীব জরুরি। খানিক বাদে অফিসে ফেরত এসে দেখল  তার কলিগরা সবাই টিভিতে রাজকুমারের প্রেস কনফারেন্স দেখছে। তুর্যয়ের পরনে সকাল বেলার সাদা রঙের ফুল হাত শার্ট। গলায় কালো রঙের টাই। ঠোঁটে হাসি নিয়ে, সারা মুখে সপ্রতিভ এক ঝংকার তুলে, স্পষ্ট গলায় সাংবাদিকদের প্রশ্নের উত্তর দিচ্ছে। তুর্যয়ের পাশের চেয়ারেই দর্পিত ভঙ্গিতে বসে আছে রিয়া। হঠাৎ চোখ পড়ল এই অগণিত ক্যামেরার  সামনে রিয়া তুর্যয়ের একটা হাত শক্ত করে ধরে আছে। কলিগদের একজন বলল, ওদের দুজনকে সত্যিই খুব মানিয়েছে। আই উইশ ওদের সম্পর্কটা খুব তাড়াতাড়ি পরিণতির দিকে এগিয়ে যাক। 


এই কথায় বাকিরা সায় দিল। আরেকজন বলল, ‘আমি এই জুটিকে ভীষণ পছন্দ করি। দে আর মেড ফর ইচ আদার!’ 


মেহেরু চুপ করে কিছুক্ষণ চেয়ে রইল তুর্যয় আর রিয়ার যুগলবন্দি হাতের দিকে। শুধু চেয়েই রইল। কিছু ভাবল না    ……...বললও না। কোনও অনুভূতির অনুরণন ব্যাতীতই সম্পূর্ণ বিনা কারণে তার চোখের তারায় কয়েক বিন্দু জল হীরকখণ্ডের মতো ঝিকমিক করে উঠল। বেরিয়ে এলো অফিস থেকে, পুনরায়। দেউরির সামনে দুজন প্রহরী দণ্ডায়মান। মেহেরু ভেজা চোখ নিয়ে ওদিকে আর গেলো না। ঘুরানো বারান্দা ধরে চলে এলো মহলের পশ্চাৎপাশে। এদিকটায় মহুয়ার বন ঢালু হয়ে নেমে গেছে নিচে। শহরতলীর কাছাকাছি। দূর সমুদ্রে বৃষ্টি নেমেছে। ছন্নছাড়া মেঘের দল আকাশ থেকে কীসের যেন তাড়া খেয়ে হুড়মুড় করে নেমে এসেছে পাহাড়ের বুকে। শীতল বাতাসে লেবু পাতা আর মহুয়ার  ঘ্রাণ ভাসছে। মেহেরুর শাড়ির আঁচল উড়ছিল। একটা মহুয়া গাছের গায়ে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে সে আকাশ পানে চেয়ে রইল। চোখ দিয়ে টপটপ করে ঝরে পড়তে লাগল জল। হঠাৎ মনে হলো পাহাড় থেকে লাফ দিয়ে গড়িয়ে পড়লে কেমন হয়? এই দেহটা চড়াই উৎরাই পাড় হয়ে অসংখ্য গাছের গুড়িতে ধাক্কা খেয়ে থেঁতলে গেলেই তো প্রাণ পাখিটা খাঁচা ছেড়ে উড়ে যাবে। যার জীবনে স্বপ্ন গড়ার অনুমতি নেই, তার বেঁচে থাকার কোনও অর্থ হয় না। স্বপ্নের দীপশিখাই তো মানুষকে ভবিষ্যতমুখী পথ দেখায়। গাছের পাতায় পাতায় শন শন শব্দ করছে  বাতাস। যেন ডাইনি বুড়ির অট্টহাসি। ধোঁয়াটে মেঘেরা উৎরাই হয়ে নেমে যাওয়া পাহাড়ি পথে মিছিল করে হেঁটে যাচ্ছে। নিচে আবছা ভাবে দেখা যাচ্ছে শহরতলীর বাড়িঘর। মেহেরু আচ্ছন্নের মতো ঢালু পথ বেয়ে কিছুটা নিচে নেমে এলো। দুই ফিতার স্যান্ডেল পরা পায়ের তলায় উঁচু নিচু  আগাছাযুক্ত অসম মাটি। একবার হোঁচট খেলেই গড়িয়ে পড়ার সম্ভাবনা। মেহেরুর চোখে মুখে এখন কোনও ভয় নেই। বিধুর সুন্দর মুখখানি এক অলৌকিক মুক্তির অবশ্যম্ভাবী সুখের জোয়ারে উদ্ভাসিত। হঠাৎ ধোঁয়াশা মেঘের আড়াল থেকে কে যেন কথা বলে ওঠে অস্ফুট ভাবে, ‘যেও না! এখনও সময় হয়নি! কাজ বাকি আছে!’ থমকে দাঁড়ায় মেহেরু। একটা ভয়ের শিহরণ খেলে যায় শিরদাঁড়া বেয়ে। হাত পা শিরশির করে। এক নিশ্বাসে ছুট দেয় জঙ্গল ছেড়ে।   


মহলের সম্মুখভাগে আসতেই দেখতে পেলো প্রাসাদের তোরণ খুলে যাচ্ছে। লিমোজিন গাড়ি ভেতরে ঢুকল। আবছা মেঘাচ্ছন্ন আলোয় মেহেরু দেখল তুর্যয়ের সাথে রিয়াও নেমেছে গাড়ি থেকে। মেহেরু ওদের সামনে গেলো না। দেহলির মোটা থামের পেছনে নিজেকে আড়াল করে রেখে দূর থেকে দেখল শুধু। তার এই মূহুর্তে কারো সামনেই যেতে ইচ্ছে করছে না। লুকিয়ে থাকতে ইচ্ছে করছে। 


অপরাহ্ন পেরিয়ে যাবার পর তুর্যয় নিজ বাসস্থানে ফিরে এসেছিল। কর্মচারিরা কেউই আর উপস্থিত  নেই। মেহেরু লাপাত্তা। ভৃত্যদের ওর ব্যাপারে প্রশ্ন করতেই বলল, তারা কিছু জানে না।  যেহেতু অফিস ঘরে ব্যাগ এবং মোবাইল রয়ে গেছে এর মানে সে  মহলেই উপস্থিত আছে এখনও। রিয়া তুর্যয়ের সাথেই ছিল। একজন সাধারণ কর্মচারির হদিশ জানার জন্য তুর্যয়ের এই মরিয়া ভাবটা তার ভালো লাগছে না। দোতলায় রাজকুমারের শোবার ঘরে আসার পর সে একটু বিরক্ত গলায় বলল, ‘তুই কী শুরু করলি? ওই মেয়ে যেখানে আছে থাকুক না। তোর কী এমন জরুরি প্রয়োজন পড়ে গেলো শুনি?’  


তুর্যয়ের ব্যক্তিগত সুবিশাল কক্ষটি আধুনিক সাজে সজ্জিত। দেখলে মনে হয় পাঁচ তারা হোটেলের  বিলাসবহুল সুইট। পায়ের তলায় চকচকে মার্বেল পাথরের মেঝে। একধারে দামি কারুকার্য খচিত সাদা আর সোনালি হাতল বিশিষ্ট সোফা সেট। সোফার মুখোমুখি  দেয়ালে ষাট ইঞ্চি পর্দার এল ই ডি টিভি।  রাজকীয় পালঙ্কের পাশে শোভা পাচ্ছে সাদার ওপর সোনালি কাজ করা মেহগনি কাঠের সুপ্রশস্ত ড্রেসিংটেবিল। কক্ষর প্রতিটি কোণায় দুর্লভ প্রজাতির ক্যাকটাস এবং বনসাই। দেয়ালে কোটি টাকা মূল্যের তৈলচিত্র। এই ঘরে সুইচ টিপলে দরজা জানালা আপনাআপনি খুলে যায়, আবার সুইচ টিপলে বন্ধ হয়ে যায়। পুব দিকের দেয়ালে একটি ছয় ফিট প্রস্থ এবং নয় ফিট উচ্চতা বিশিষ্ট জানালা  খোদাই করা আছে।  কাচের পাল্লাটা তুলে দিলেই জানালার সাথে লাগোয়া দুটি সিঁড়ির ধাপ পার হয়ে ঝাঁপ দেয়া যায় সুইমিং পুলে। নীল জলের হ্রদের মতো লম্বাটে সুইমিং পুলটা পাহাড়ের একদম কোল ঘেঁষে অবস্থিত। তিন দিকে বনাঞ্চল আর সম্মুখে আদিগন্ত বিস্তৃত আকাশ।   


তুর্যয় পালঙ্কের ওপর গা এলিয়ে দিয়ে আলসে গলায় বলল, ‘রিয়া, আমার খুব টায়ার্ড লাগছে। তুই এক কাজ কর, বাসায় ফিরে যা। উইকেন্ডে মিট করব আবার। কেমন?’ 


রিয়া বিনা সংকোচে বলল, ‘তুই আমার জন্য কী এনেছিস লন্ডন থেকে?’ 


তুর্যয়ের মনে পড়ল হঠাৎ, ‘ওহ ভুলেই গিয়েছিলাম। তোর দেয়া লিস্ট ফলো করে সবকিছুই এনেছি। এখুনি চাই?’ 


রিয়া উৎসাহে জমে যায়, ‘হ্যাঁ দেখা না! গিফট দেখতে তো মজাই লাগে!’ 


কলিং বেলটা টিপতেই একজন চাকর দৌড়ে এলো। তুর্যয় আদেশ করল ক্লজেটে রাখা স্যুটকেস গুলো বের করে নিয়ে আসার জন্য। স্যুটকেস আসা মাত্র রিয়া ওগুলোর ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ল। সেই সময় একজন ভৃত্য এসে খবর দিল মেহেরুকে পাওয়া গেছে। অফিস ঘরে উপস্থিত আছে। তুর্যয় মেহেরুকে ওপর তলায় ডেকে পাঠাল। 


স্যুটকেসের মধ্যে একটা বড়সড় প্লাস্টিক ব্যাগের ওপর নাম লেখা ছিল গোটাগোটা অক্ষরে ‘ RIA’  


রিয়া সেই ব্যাগ তুলে নিয়ে গদগদ গলায় বলল, ‘থ্যাঙ্ক ইউ দোস্ত!’ 


-’পেয়েছিস তো। এখন ভাগ।’ 


রিয়া বসল বিছানার ওপর। তুর্যয় তখনও চিৎ হয়ে শুয়ে আছে। তার চুল উষ্কখুষ্ক। মুখে ক্লান্তির ছাপ। শার্টের দুটা বোতাম খোলা। ফর্সা বুকের ওপর কিছু এলোমেলো কোঁকড়া চুল। পা দুটো ঝুলছে পালঙ্কের বাইরে।


-‘আমাকে তাড়াবার জন্য এতো ব্যস্ত হয়ে উঠেছিস কেন? কারণ কী?’  


-’টায়ার্ড!' 


রিয়ার ওষ্ঠাধরে  চাপা হাসির ঝিলিক। ফিচেল সুরে বলল, ‘টায়ার্ড লাগলে মানুষকে এতো হ্যান্ডসাম দেখায়! আগে জানতাম না তো!’ 


-ফাজলামো করিস না।


-’ফাজলামো না। সত্যি! তুই আগের চাইতে আরও বেশি অ্যাট্রাক্টিভ হয়েছিস। কারণ কী? প্রেমে ট্রেমে পড়িসনি তো?’  


মেহেরুর আবির্ভাব হলো সেই সময়। তার মুখখানা ম্লান। চুলে অবিন্যস্ত একটা খোঁপা। চোখের কোল ফোলা। ঘরে ঢুকেই রিয়া আর তুর্যয়কে পাশাপাশি দেখে সে একটু অপ্রস্তুত বোধ করল। কুর্নিশ করে অপরাধী গলায় বলল, ‘মাননীয় রাজকুমার, আমাকে   ডেকেছিলেন?’ 


তুর্যয় শোয়া থেকে উঠে বসল, ‘হ্যাঁ ডেকেছিলাম।’ 


-’বলুন কী করতে পারি?' দরজার সামনে নত মুখে দাঁড়িয়ে থেকেই  আড়ষ্ট গলায় বলল মেহেরু। তুর্যয় তার চেয়ে বয়সে ছোট এ কথা ঠিক। কিন্তু ক্ষমতা, যোগ্যতা এবং পদবিতে অনেক অনেক বড়। তাই তো কম বয়সী এই যুবকের সামনে কথা বলতে গেলে অনিচ্ছা সত্ত্বেও তার মাথা নত হয়ে আসে। আসলে বয়স কিংবা অভিজ্ঞতা মানুষকে শক্তি দেয় না, প্রকৃত শক্তির যোগানদার হলো ক্ষমতা এবং আর্থিক প্রাচুর্য। তিতকুটে হলেও এটাই বাস্তব সত্য।  


-’দাঁড়িয়ে কেন? বসুন প্লিজ!’ 


রিয়া অবাক হয়ে চাইল তুর্যয়ের দিকে। একটা থার্ডক্লাস এমপ্লয়িকে নিজের ঘরে ডেকে এনে এত সম্মান দেখানোর কারণ কী? তুর্যয়ের কি মাথা খারাপ হয়ে গেছে? ওদিকে মেহেরু জড়সড় হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। তুর্যয়ের কথা যেন কানেই ঢোকেনি। তার  ভেতরে যার-পর-নাই অস্বস্তি ঢেউ ভাংছে। রিয়ার সাথে এর আগে সামনা সামনি কখনও দেখা হয়নি। টিভিতে দেখেছে, পত্রিকায় দেখেছে। পুরো দেশ রিয়ার জন্য পাগল। তার ফ্যান ফলোয়ারের সংখ্যা কোনও  সুপার স্টারের চেয়ে কম নয়। এত নামকরা ব্যক্তিত্বর সামনে প্রথমবার দাঁড়ালে স্বাভাবিক ভাবেই মানুষ নার্ভাস হয়ে পড়ে। মেহেরুও ব্যতিক্রম নয়। 


তুর্যয় রিয়াকে বলল, ‘তুই চলে যা। রাত দশটা থেকে কারফিউ। দেরি করা ঠিক হবে না।’ 


রিয়ার মুখটা একটু ঝুলে গেলো। উপহারের প্যাকেট  হাতে নিয়ে সে হাইহিল জুতো জোড়া পায়ে পরে নিল। কপালে দুশ্চিন্তার প্রলেপ। কিছু একটা বিঁধছে কাঁটার  মতো বুকের ভেতর। কিন্তু এখন তুর্যয়ের সাথে কথা বলতে যাওয়া বোকামি হবে। এই দুই টাকার চাকরানির সামনে দুর্ব্যবহার করে বসলে মান ইজ্জত নিয়ে টানাটানি পড়বে। তাই কথা না বাড়িয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে গেলো সে। রিয়ার প্রস্থানের পর তুর্যয় একটু উঁচু গলায় মেহেরুকে বলল, ‘আপনাকে বসতে বলেছি। দাঁড়িয়ে আছেন কেন?’  


-'বসব না। কেন ডেকেছেন বলুন।’ 


-’আপনাকে খাতির করার জন্য বসতে বলা হয়নি। আদেশ দেয়া হয়েছে।' গমগমে স্বরে বলে ওঠে রাজার কুমার!  


রাগ হজম করে মেহেরু হেঁটে এসে সোফার ওপর বসল। ঘরটা হরেক রকম বাতিতে ঝলমলে হয়ে আছে। প্রতিটি আসবাব এতো বেশি ঝকঝকে তকতকে যে মনে হচ্ছে যেন তাদের প্রত্যেকের গা থেকে আলোকরশ্মি ঠিকরে বেরোচ্ছে। তুর্যয় এগিয়ে এসে মেহেরুর মুখোমুখি সোফায় বসল। তীক্ষ্ণ চোখে ওর দিকে চেয়ে বলল, ‘আপনার কী হয়েছে?’ 


-’কিছু না।’ 


-’আপনি মাথা নিচু করে আছেন কেন? আমি আপনার মুখ দেখতে পাচ্ছি না।’


মেহেরু নড়ল না। কিছু বললও না। পাথর হয়ে বসে রইল। এই অবাধ্যতা দেখে তুর্যয়ের মুখের ভঙ্গি পালটে গেলো নিমেষে। চোখ জ্বলে উঠল। 


-'আপনি কি আমার কথা শুনতে পাচ্ছেন না?'  


তারছেড়া ক্রোধের বহ্নিশিখায় ভেতরটা জ্বলে পুড়ে খাঁক হয়ে যাচ্ছিল মেহেরুর। সে চট করে মুখ তুলে তাকাল তুর্যয়ের দিকে। আগুন ঝরা গলায় কেটে কেটে  বলল, ‘শুনতে পেয়েছি!  এখন কী করতে হবে?’  


চোখের সামনে ওই খাঁড়া নাক, মদিরদৃষ্টি হরিণী দুটি চোখ আর সুচালো চিবুক সম্বলিত পবিত্র মুখখানা ঝিলিক দিয়ে ওঠার সঙ্গে সঙ্গে তুর্যয়ের গায়ে যেন মন জুড়ানো ঠাণ্ডা বাতাসের ঝাপটা এসে লাগল। প্রশান্তির ধারা প্রবাহিত হতে লাগল রক্তের ধমনীতে। গোলাপি ওষ্ঠে ফুটে উঠল দুরন্ত হাসির রেখা। চকলেট খাবার পর জিভে যেমন অনেকক্ষণ অবধি মিষ্টি একটা রেশ লেগে থাকে, যুবরাজের এই দুরন্ত হাসিটুকুও অনেকটা সময় ধরে চকলেটের মিঠা স্বাদের মতো মনের সাথে আষ্টেপৃষ্ঠে লেপটে থাকে। ওই হাসি দেখে অজান্তেই মেহেরুর বুকের পাঁজরে শিরশিরে এক কাঁপন ধরল। চোখ সরিয়ে নিল সে। কঠিন ভাবে   বলল, ‘কেন ডেকেছেন?’ 


তুর্যয় সোফার পিঠে হেলান দিয়ে আয়েশি গলায় বলল, ‘আপনাকে দেখতে ইচ্ছে করছিল। তাই ডেকেছি।’ 


-’বেশ তো। দেখুন!’ কথাটা বলতে গিয়ে মেহেরু যেন আরও বেশি শক্ত হয়ে গেলো। ফুলে ঢোল হয়ে উঠল নাকের পাটা। মনে মনে রাগ ঝাড়তে লাগল, ক্যামেরার সামনে যার হাত ধরে বসে ছিলে তাকেই সামনে বসিয়ে রেখে দ্যাখো না! আমাকে অযথা টেনে আনা কেন? 


তুর্যয় হাসতে হাসতে বলল, ‘বসের সাথে কীভাবে কথা বলতে হয় আপনি সেটাও জানেন না। একগুয়েমির সীমা থাকা চাই। যাই হোক, ওই টেবিলের ওপর একটা ওয়াইনের বোতল রাখা আছে। নিয়ে আসুন প্লিজ।’ 


মেহেরু রাগে কাঁপতে কাঁপতে উঠে দাঁড়ালো। তার শাড়ির আঁচল অবিন্যস্ত। মেঝেতে লুটাচ্ছে। পদব্রজে হনহন করে এগিয়ে পালঙ্ক পার্শ্বস্থ তেপায়া টেবিলের ওপর থেকে ওয়াইনের বোতলটা তুলে নিল সে। সোফার কাছে ফিরে এসে তুর্যয়ের দিকে বোতলটা বাড়িয়ে দিল। মুখ ফিরিয়ে রাখল অন্যদিকে। 


তুর্যয় বোতলটা হাতে নিয়ে বলল, ‘এবার খোলা চুলে  আমার সামনে এসে দাঁড়ান। ওই ঝাড়বাতির নিচে। ‘ 


-'কেন?'  


-'খোলা চুলে আপনাকে অনেকদিন দেখি না। তাই!' 


-'আপনার প্রতিটা কথা আমি মানতে বাধ্য নই।’ 


-’নিশ্চয়ই বাধ্য। ‘


-’ভুল ধারণা।’ 


-’আমি রাজ্যের যুবরাজ। সমঝে কথা বলবেন। চাইলে এই মুহুর্তে আপনাকে দেশছাড়া করতে পারি। জানেন তো!' 


-’করলে করেন। এই ফালতু দেশে থাকার আর ইচ্ছে নেই আমার।’ 


-'যা বলছি করুন। সময় নষ্ট করছেন কেন?’  


মেহেরুর সারা শরীর রাগে চিড়বিড় করছে। সাপের মতো ফুঁসতে ফুঁসতে খোঁপাটা খুলল সে। পিঠময় চুলগুলো ছড়িয়ে পড়তেই কী অপরুপ দেখালো তাকে! যেন পটে আঁকা নিখুঁত ছবি! স্বর্গের অপ্সরাও বুঝি এই   সৌন্দর্যর কাছে হার মানবে!   


-’আমার দিকে তাকান।’ 


-’অসহ্য!’ না চাইতেও শব্দটা বেরিয়ে আসে মেহেরুর মুখ থেকে।  


তুর্যয় হাসে, ‘রাগছেন কেন? জলপরিদের এতো রাগতে নেই!’ 


অনেক দিন পর নামটা শুনতে পেলো মেহেরু। বুকের মধ্যে ব্যথার মতো কী যেন একটা বেজে উঠল চকিতে। উদ্বেলিত বক্ষ নিয়ে তাকালো তুর্যয়ের দিকে। ওই ধূসর দুটি চোখের তারায় এখন মাদক মাদক রেশ। ছিপছিপে মুখে ক্লান্তির গাঢ় ছাপ। হঠাৎ কেমন মায়া হলো। মনের মধ্যে ফিরে এলো নম্রতা। মেহেরু  ব্যগ্র ভাবে  বলল, 'আপনার কি শরীর খারাপ লাগছে?'    


-'শরীর ঠিকই আছে। অসুখটা মনে।' 


-'মনের আবার কী ছাইপাশ হলো?' মেহেরু ভর্ৎসনা করে ওঠে। 


-'হয়েছে কিছু একটা। ' 


-'সাইকিয়াট্রিস্ট দেখান। ' 


-'ওসব লাগবে না। আপনিই চাইলে সারাতে পারেন মনের অসুখটা। ' ওয়াইনের বোতলে চুমুক দিয়ে দ্বিধাহীন গলায় বলে তুর্যয়। 


-'আমি কী করে সারাব?'  


-'একটু আদর করে দিন না! আপনি  কাছে এলেই তো অসুখটা সেরে যায়!'  


মুখে হাসি নিয়ে ভারি করুণ গলায় আবদার করে  যুবরাজ। লজ্জায় মেহেরুর মুখখানা  রক্তিম হয়ে ওঠে। তুর্যয় নির্বিকার চিত্তে বলে, 'লজ্জা পেলে আপনার গাল আপেলের মতো টসটসে হয়ে যায়। মন চায় কামড় দিয়ে কচকচ করে খেয়ে ফেলি।'  


-'ধুর!' আস্তে করে বলে মেহেরু।  


একটা চাপা সুপ্তোত্থিত হাসিতে মাখো মাখো হয়ে আছে তার সারা মুখ। লজ্জা লাগছে ... আবার কী ভীষণ ভালোও লাগছে! 


তুর্যয় বলেছে বলেই কথাগুলো সুন্দর লাগল তার কানে। অন্য কেউ বললে কী কদর্যই না লাগত! ভাগ্যিস আজ বিকেলে সে আত্মহত্যা করেনি। বেঁচে আছে বলেই এই এক টুকরো সুখ তার নিরানন্দ জীবনের ছিদ্রিত আকাশ ভেদ করে টুপ করে এসে পড়ল মনের দুয়ারে। সে আরক্ত মুখে বলল,  'আমি যাই। কারফিউ শুরু হতে খুব বেশি দেরি নেই। আপনি বিশ্রাম নিন। শুভরাত্রি!' 


-'শুভরাত্রি আমার জলপরী! হ্যাভ আ সেফ ড্রাইভ!' 


ক্ষীণ কণ্ঠে বলল তুর্যয়। 


মেহেরু আর একটি শব্দও উচ্চারণ না করে দ্রুত পায়ে   প্রস্থান করল। দরজার বাইরে যখন এসেছে তখন তার চোখের কোল ভেজা। বুক কাঁপছে এক মদির ভালোলাগার আচ্ছন্ন আবেশে!  কয়েক পা এগোতেই একটা দৃশ্য দেখে চমকে উঠল সে। সিঁড়ির মুখে রিয়া দাঁড়িয়ে আছে। চোখে মুখে কূট সন্দেহের তীব্র ঝঙ্কার।  


---------


এই লেখা কেউ কপি করবেন না। যদি আমার অনুমতি ব্যতীত আমার লেখা কোথাও পোস্ট করা হয় তবে  আইনগত ব্যবস্থা নেয়া হবে। কপি কারীকে আমার লইয়ার সরাসরি লিগ্যাল নোটিশ পাঠাবে।

No comments

Powered by Blogger.