গল্প | উড়ান মেঘের দেশে - পর্ব-১৬ | Oran megher deshe - Part-16

লেখিকা-ওয়াসিকা নুযহাত 


রবীন্দ্রনাথ রুপনারাণের কূলে জেগে উঠেছিলেন, আজ রাশিকা জেগে উঠল সমুদ্রকুঞ্জের স্বপ্নপুরীতে। চোখ খোলার পরেও সে অনেকক্ষণ অবধি বিস্মৃতির অতল সাগরে ডুবে রইল।

মস্তিষ্ক শূন্যতায় ভরা। তবে চারপাশের জগত স্বপ্নালু হলেও স্পষ্ট এবং সহজবোধ্য। সে নিজেকে দেখতে পাচ্ছে পেলব জাজিমের রাজকীয় পালঙ্কে। একটি সাদা রঙের জাফরিকাটা মশারি পালঙ্কের চারিধারে পর্দার মতো ঝুলছে। ফিনফিনে পর্দার বাইরেটা সুর্যের সোনালি আলোয় উদ্ভাসিত। নাকে একটা মিষ্টি ঘ্রাণ এসে লাগছে। হাত বাড়িয়ে পর্দা সরাতেই চোখে পড়ল একটি চমৎকার দৃশ্য। খোদাই করা নকশা আঁকা দুটি মোটা থাম গাছের মতো মাথা উঁচিয়ে প্রায় চল্লিশ ফিট উঁচু ছাদটাকে ধরে রেখেছে। দুটি থামের মধ্যিখানে দশ গজের দূরত্ব। মধ্যবর্তী পরিসরে মার্বেল পাথরের ধবধবে সাদা সিঁড়ি তিনটি ধাপে বিভক্ত হয়ে ওপরে উঠে গেছে। মিশেছে গম্বুজ আকারের জানালার কার্নিশের সাথে। সুপ্রশস্ত কার্নিশের ওপর দুটি টকটকে লাল গোলাপের ফুলদানি। স্বচ্ছ কাচের গম্বুজাকৃতির জানালার ওপাশে ঝুলছে সাদা আর গোলাপি বাগান বিলাসের ঝাড়। রাশিকা শোয়া থেকে উঠে মার্বেল পাথরের মেঝেতে পা রাখল। কী ঠাণ্ডা! মন প্রাণ একদম জুড়িয়ে যায়! ময়ূরের মতো পেখম মেলে নাচতে নাচতে সে সিঁড়ি ভেঙে জানালার ধারে চলে এলো। মধ্যযুগীয় আমলের ভারি কাচের জানালার দুটি পাল্লা খুলতেই সকাল বেলার ফুরফুরে দমকা বাতাস তার ঘাড় পর্যন্ত পড়ে থাকা এলোমেলো সিল্কি চুলগুলো উড়িয়ে দিয়ে গেলো। প্রাসাদের ভেতর ঢুকে পড়ল একটা দুটো দলছুট মেঘ। সমুদ্রের গর্জন এসে ধাক্কা খেলো কানে। বাইরে প্যাস্টেল রঙে আঁকা ঝকঝকে নীল আকাশ। আর তার নিচে সবুজ ঘাসের কার্পেট ওয়ালা গোল চত্বর। প্রায় সাত আটটি সাদা পাথরের মূর্তি চত্বরটিকে ঘিরে রেখেছে। মাঝখানে একটি বিশাল বড় দাবা খেলার সাদা কালো ছকওয়ালা পাথুরে বোর্ড। দাবার গুটি গুলো তামার তৈরি। দিনের আলোয় চকচক করছে। মানুষের চাইতেও প্রকান্ড তাদের আকার। দোতলার বারান্দা থেকে রাশিকা দেখতে পেলো দাবা বোর্ডের প্রান্ত ঘেঁষে দু তিনজন মানুষ বসে আছে। কতিপয় ভৃত্য গোছের লোক খেলোয়াড়দের আদেশ মোতাবেক গুটি গুলিকে এদিক সেদিক নাড়াচ্ছে। এদের মধ্যে একজনকে তার চেনা চেনা লাগছে। কয়েক সেকেন্ডের মধ্যেই মানুষটাকে সে পুরোপুরি চিনে ফেলল। চেনা মাত্র স্বপ্নলোকের এই বিচরণ বিঘ্নিত হলো। কালবৈশাখীর ঝড়ের মতো শোঁশোঁ করে স্মৃতির অলিন্দে ভিড় জমালো গতরাতে ঘটে যাওয়া ভয়াবহ দুর্ঘটনা। অমনি সর্বাঙ্গে একটা দুর্মর ব্যথা বিষের মতো ছোবল দিয়ে উঠল। একটু একটু করে সমস্তটাই মনে পড়ছে।শরীরে ক্ষত এখনো শুকায়নি। কিন্তু ক্ষতর জায়গায় কে যেন ব্যান্ডেজ বেঁধে দিয়েছে। কুনুইয়ে, ঘাড়ের কাছে, হাঁটুতে। পরনের জামাও পাল্টে গেছে। একটা ঢোলা টিশার্ট আর ট্রাউজার। মেয়েদের পোশাক নয় তা দেখলেই বুঝা যায়। গতকাল গভীর রাতে জঙ্গলের ভেতরে ওই নীল চোখ ওয়ালা হিংস্র প্রাণীটা আসলে কী ছিল? প্রচণ্ড ভয় পেয়ে গিয়েছিল সে। রাজকুমার তাকে সঙ্গে নিয়ে অন্ধকারে ছুট দিয়েছিল। ভয়ের দাপট অসহনীয় পর্যায়ে পৌঁছে গিয়েছিল তখন, যখন রাশিকার মনে হয়েছিল এই মানুষরুপী রাজকুমার আসলে মানুষ নয়। কারণ একজন মানুষের গতি কখনও এহেন ক্ষিপ্র হতে পারে না। এরপর আর কিছুই মনে নেই। অকেজো টেলিভিশনের ঝিরঝির করা পর্দার মতো নিরেট সবকিছু। এই মূহুর্তে ভাঙাচোরা স্মৃতি গুলো একলা একলা ফিরে আসেনি, কাল রাতের ভীতি, শঙ্কা এবং আতঙ্কজনিত কম্পনের সমস্তটাই পরিপূর্ণ ভাবে সঙ্গে নিয়ে এসেছে। 


রাশিকা অপ্রকৃতস্থ বিহ্বল চোখ নিয়ে সুবিশাল কক্ষটির প্রবেশ দ্বার খুঁজতে লাগল। পাওয়া গেলো, কিন্তু ভারী কাঠের পাল্লাটা কোনও ক্রমেই খোলা গেলো না। তাকে কি বন্দি করে রাখা হয়েছে? উন্মাদিনীর মতো ত্রস্ত পায়ে জানালায় ফিরে এলো। উপায় না পেয়ে চিৎকার করে উঠল, ‘অ্যাই রাজকুমার!’ 


নির্জন চত্বরে কিন্নর কণ্ঠের ডাকটা যেন প্রতিধ্বনিত হয়ে ছুটে গেলো দূর থেকে দূরান্তরে। নিচে উপস্থিত প্রতিটি মানুষ মুখ তুলে তাকালো। এদের মধ্যে যাকে রাশিকা চেনে তার উদ্দেশ্যে অত্যন্ত কাতর কণ্ঠে বলল, ‘শোনো, ভাই রাজকুমার, একটু শুনে যাও! প্লিজ!’ 


অজয়ের সাথে ব্যাড বয়েজ ক্লাবের দুজন সদস্য উপস্থিত আছে। এই দুই তরুণ তার বাল্যকালের সখা। বিশ্বাসভাজন এবং শুভাকাঙ্ক্ষী। অজয় অবশ্য খুব কাছের বন্ধুদের সাথেও নিজেকে খোলামেলা ভাবে মেলে ধরতে পারে না কখনও। আজকে বন্ধুরা তার পরিবর্তিত রুক্ষ এবং রুগ্ন চেহারা দেখে হাজার রকম প্রশ্ন করেছে, সে প্রতিটা প্রশ্নের পাশ কাটানো উত্তর দিয়েছে। ধরা দেয়নি কিছুতেই। গতকাল রাতের ভয়াবহতার পর একা থাকতে মন চাইছিল না। নানারকম দুশ্চিন্তায় কাঁটা হয়ে আছে মন। তাই বন্ধুদের ডেকে এনেছে। এনেও লাভ হয়নি। খেলায় মনোযোগ নেই। নিজেকে দাবার চালে ভুলিয়ে রাখার সর্বাত্মক চেষ্টা করে যাচ্ছিল। মন বসাতে পারছিল না। পরপর দুই দান হেরে বসে আছে। এখন তৃতীয় দফা চলছে। 


রাশিকা দোতলার বাতায়নে দাঁড়িয়ে আছে। তাকে দেখাচ্ছে অভিমানী কিশোরী বালিকার মতো। বিশাল ঢোলা শার্ট প্যান্ট, এলোমেলো বাবরি চুলের মাঝখানে একটি ছোট্ট সুললিত মুখ। পদ্মকোরকের ন্যায় পাতলা লালচে দুটি ঠোঁট ঈষৎ ফোলা। চোখ টলটলে ঝাপসা, যেন টোকা দিলেই জল গড়িয়ে পড়বে।    


বন্ধু সুরজিৎ প্রশ্ন করল, ‘এইটা কে? নতুন নাকি?’ 


মহলে অজস্র নারীর যাতায়াত আছে। কেউ আসে বন্ধু বেশে, আবার কেউ আসে ভাড়াটে বারবনিতা হয়ে। পরিচয় যেটাই হোক না কেন এখানে নারী পুরুষের অবাধ মেলামেশায় কোনও বাধা নেই। একই নারী অজয় সহ ক্লাবের প্রতিটি সদস্যর শয্যা সঙ্গিনী হয়েছে, এমন ঘটনারও নজির আছে। যারা আসে, তাদের ভাব ভঙ্গি অন্যরকম। রাশিকার মতো সাধারণ, ছলাকলাহীন শিশুসুলভ আচরণের মেয়েকে রাজপুত্রের চিত্তরঞ্জক রমণ সঙ্গী হিসেবে যেন একেবারেই মানায় না। বন্ধুরা তাই এই অতি সাধারণ আলাভোলা ধরণের মেয়েটিকে দেখে অবাক না হয়ে পারল না। 


বন্ধুদের সামনে অপ্রস্তুত বোধ করল অজয়। নিরুত্তাপ গলায় বলল, ‘কেউ না।’


বন্ধুরা একজন আরেকজনের মুখ চাওয়া চাওয়ি করল। কিছু বলল না। আজ প্রথম থেকেই তারা লক্ষ্য করছে অজয়ের মেজেজ মর্জি ভালো না। হাজার হোক রাজ্যের রাজপুত্র বলে কথা। বন্ধুরাও তাকে সময় বুঝে সমীহ করে চলে। তাই মুখে মুখে তর্ক করল না কেউ। চুপ করে রইল। অজয় বসা থেকে উঠে দাঁড়িয়ে বলল, ‘আমি একটু আসছি। তোরা কনটিনিউ কর।’ 


একজন ভৃত্য অজয়কে অনুসরণ করতে যাচ্ছিল। অজয় হাত দিয়ে থামিয়ে দিল তাকে। এই চত্বরটা মহলের পেছন দিকে। কোনও দরজা নেই এদিকটায়। অজয়কে সদর দরজা পর্যন্ত হেঁটে আসতে হলো। লম্বা করিডোর আর ঘুরানো সিঁড়ি পেরিয়ে দোতলায় উঠে এলো। সর্ব দখিনের ঘরটা রাশিকাকে দেয়া হয়েছে। এখানে মোট ঘরের সংখ্যা কত তা অজয় নিজেও জানে না। লেট নাইট পার্টি হলে মদ্যপ বন্ধুরা ইচ্ছেমত যেকোনো ঘর দখল করে নেয়। অজয় কখনও মেয়েদের নিয়ে নিজের শোবার ঘরে যায় না। সুবিশাল মহলের আনাচে কানাচে যেকোনো নির্জন কক্ষে হয় তার সম্ভোগ উপসেবন। তাই ঘরগুলো সর্বদা খোলা থাকে। তবে আজ রাশিকার ঘরটা রাজকুমারের নির্দেশে বিশেষ ভাবে তালা দেয়া হয়েছে। একে সহজে ছেড়ে দেয়া যাবে না। গতকাল রাতে ঘটে যাওয়া দুর্ঘটনার একমাত্র সাক্ষি হলো এই মেয়ে। যেকোনো উপায়ে এর মুখ বন্ধ রাখতে হবে।  


অজয়ের পকেটে চাবি ছিল। তালা খুলে ভেতরে ঢুকতেই দেখল রাশিকা পালঙ্কের ওপর হাত পা গুটিয়ে বাবু হয়ে বসে আছে। সোনালি আলোয় ভরে আছে সারা ঘর। কয়েকটা সাদা মেঘ কুয়াশার মতো উড়ে বেড়াচ্ছে নিরুদ্দেশ। মৃদু বাতাসে দুলছে মশারির পর্দা, উড়ছে রাশিকার এলোমেলো রেশমি চুল। অজয় রাশিকাকে এক নজর দেখে নিয়ে দরজাটা বন্ধ করল। এই কক্ষে বসার জন্য কোনও বাড়তি আসন নেই। অজয় হেঁটে এসে জানালা সংলগ্ন সিঁড়ির শেষ ধাপে বসল, পা ছড়িয়ে। ওর পরনে একটা কালো রঙের হাফপ্যান্ট। নীল সাদার মিশেলের পাতলা টিশার্ট। চুলগুলো পেছনে ঝুঁটি করে বাঁধা। মুখের চামড়ায় একটু একটু কালো দাড়ির আভাস। প্রায় ছয় ফিটেরও অধিক লম্বা শরীরটি অত্যন্ত সবল এবং দৃঢ়। দেখলেই বোঝা যায় ক্রীড়া কৌশল এবং দৌড় ঝাঁপে অভ্যস্ত। এই তামাটে দীর্ঘকায়, রুক্ষ এবং উগ্র রুপের আষ্টেপৃষ্ঠে যে এক ঝাঁঝালো দুরন্ত পৌরুষের শ্রীময় উপস্থিতি বিদ্যমান সেই বাস্তবতাটুকু বোধহয় অস্থিরমতি রাশিকার পরিবর্তে অন্য যে কোনও পর্যবেক্ষণ শক্তি সম্পন্ন পরিণতমনস্কা নারী হলে ঠিক ঠিক টের পেত। 


রাশিকা লাফ দিয়ে বসা থেকে উঠে দাঁড়ালো, ‘কাহিনী কী?’ 


অজয় এক পৃথিবী বিরক্তি নিয়ে বলল, ‘কাহিনী হচ্ছে তুমি ভয়ে বেহুঁশ হয়ে গিয়েছিলে অন দ্যা স্পট। তারপর তোমাকে চ্যাংদোলা করে বহন করতে হয়েছে আমার।’  


-'কেউ দেখেনি তো?' 


-'হু নোজ!' 


-’লাশটার কী হলো?’ 


-’ওখানেই ফেলে আসতে হয়েছে। ‘ দুশ্চিন্তাগ্রস্ত শোনায় অজয়ের গলা। 


-’আর ওইটা কী ছিল?’ 


-’কোনটা?’ 


-’ওই যে নীল নীল চোখ! ওরে বাবা কী ভয়ঙ্কর!’ 


-’জানি না!’ 


-’জানো না?’ 


-’উঁহু। নেকড়ে হতে পারে। আমি ফরেস্ট ডিপার্টমেন্টে কমপ্লেইন করিনি। কারণ গতরাতে আমি জঙ্গলে ছিলাম এটা কোনভাবেই কারো টের পাওয়া চলবে না।’ 


রাশিকার মুখে পাঁশুটে প্রলেপ পড়ে। জমে যাওয়া ভয়ার্ত গলায় বলে, ‘ভূত টূত না তো আবার!’ 


অজয় হেসে ফেলল, ‘হতে পারে!’ 


-’কী আজব! রাক্ষসকুমারও হাসতে পারে? ক্যামনে কী!’ 


নিজের হাসিতে অজয় নিজেও অবাক হলো কিঞ্চিৎ। সে এমনিতেই গম্ভীর মুখো মানুষ।উপরন্তু গত দু তিনদিনের শারীরিক অসংলগ্নতা তাকে এমন এক অবস্থায় ঠেলে দিয়েছিল যে আবার কোনদিন হাসতে পারবে মন খুলে এই সম্ভাবনাকে হঠাৎ হঠাৎ অলীক বলে মনে হচ্ছিল। কিন্তু সামনে এহেন জ্বলজ্যান্ত কার্টুন উপস্থিত থাকলে মৃত মানুষও মনে হয় হেসে উঠবে। রাশিকা বলল, ‘আমাকে বন্দি করে রেখেছ কেন?’ 


-’যাতে তুমি কোথাও যেতে না পারো।’ 


-’মানে? আমি কি সারাজীবন এই ঘরে বন্দি হয়ে থাকব?’ 


-’হয়তো!’ উদাস গলায় উত্তর দেয় রাজকুমার।  


রাশিকা কোমরে হাত রেখে অত্যন্ত ঝগড়াটে গলায় বলে, ‘ফাইজলামি করো? কেন আমাকে আটকে রাখতে চাইছ?’ 


-’কারণ তুমি বোকা।’ অজয়ের সজাসাপটা উত্তর। বড়ই ক্ষিপ্রতা ব্যাঞ্জক তার অঙ্গভঙ্গি।  


রাশিকার মুখটা অপমানে কালো হয়ে উঠল। 


-’আমি বোকা? আর তুমি কী? তুমি তো একটা খুনি। আস্ত একটা মানুষ খু …’ রাশিকা কথাটা শেষ করতে পারল না। অজয় তার আগেই লাফিয়ে ছুটে এলো ওর কাছে। রোমশ বাদামি হাত দিয়ে ওর মুখ শক্ত করে চেপে ধরে নিচু গলায় বলল, ‘শশশ … দেয়ালেরও কান আছে! একদম চুপ!’ অজয়ের গতি এতবেশি তীব্র এবং আকস্মিক ছিল যে রাশিকা পিলে চমকে উঠেছে। তার দুর্বল হৃৎপিন্ড কাঁপছে নীড় নষ্ট হওয়া অসহায় পাখির মতো। অজয়ের হাতে এতো জোর! মনে হচ্ছে যেন ওই পাঁচ আঙ্গুলের নিচে তার মুখটা থেঁতলে যাচ্ছে। সেই অবস্থায়ই ঘাড় উঁচু করে বিশাল লম্বা মানুষটার মুখপানে চাইতেই রাশিকার মনে হলো এমন ক্ষুরধার উন্মত্ত চেহারা সে জীবনে এই প্রথম দেখল। মনে হয় যেন এখুনি সমস্তটা লুটপাট করে নেবে এই বনচারী হিংস্র মানুষ। তার চোখ ফেটে জল গড়িয়ে আসল এবার। ঝরঝর করে কাঁদতে লাগল। কান্না দেখে ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেলো অজয়। চকিতে হাতটা সরিয়ে নিয়ে অপ্রস্তুত গলায় বলল, ‘কী আশ্চর্য! কাঁদছ কেন?’ 


রাশিকা কাঁদতে কাঁদতে বলল, ‘এতো জোরে মুখ চেপে ধরলে কেন? ব্যথা লাগে না বুঝি?’ 


অজয় দেখল সত্যিই রাশিকার শ্যাম বরণ কোমল মুখের চামড়ায় লালচে একটা দাগ পড়ে গেছে। একটু বিব্রত ভাবে চুপ করে রইল কিছুক্ষণ। তারপর বলল, ‘ব্যথা পেলেই কাঁদবে? তুমি কি ছোট বাচ্চা?’ 


আসলে রাশিকা কাঁদছিল অন্য কারণে। হঠাৎ করেই তার গত রাতের দুঃসহ স্মৃতিটুকু মনে পড়ে গিয়েছে। ওই মানুষরুপি জানোয়ার গুলো তাকে যেভাবে চারপাশ থেকে জাপটে ধরেছিল, অজয়ের ছোঁয়া সেই তুলনায় অনেক বেশি সরল। কিন্তু ও কাছে আসতেই সেই ভয়ঙ্কর অনুভূতিটুকু শুয়ো পোকার মতো কিলবিল করে উঠে এলো মনে। ঘেন্নায় রিরি করে উঠল সারা শরীর। এরপর থেকে হয়তো সে কোনও পুরুষের নৈকট্যই কখনও সহ্য করতে পারবে না। আচানক ভাবে তুর্যয়ের মুখটা ভেসে উঠল মনশ্চক্ষে। মনে হল পৃথিবীতে ওই একজন মাত্র পুরুষই আছে যে কিনা নিষ্কন্টক এবং নির্লোভ। সারা পৃথিবী একদিকে আর ওই মানুষটা অন্যদিকে। সে চোখের জল মুছতে মুছতে অজয়কে বলল, ‘দ্যাখো ভাই রাজকুমার, আমি মস্ত ভুল করেছি তোমাদের দেশে এসে। আমাকে প্লিজ মুক্তি দাও। আমি নিজের দেশে ফিরে যাব।’ 


অজয়ের ভ্রু জোড়ায় কুঞ্চন সৃষ্টি হয়, ‘তোমাকে বিশ্বাস করব কোন যুক্তিতে?’  


-’অবিশ্বাসই বা করবে কেন?’  


-’ঠিক অবিশ্বাস নয়, তোমার ওপর আসলে আমি ভরসা পাচ্ছি না। তুমি বড্ড বোকা।’ 


-’ভরসা পাচ্ছ না মানে? আমি কী করতে পারি বলে তোমার ধারণা?’ 


-’আমার ধারণা তুমি যাকে সামনে পাবে তাকেই গতরাতের ঘটনা বলে দেবে। তোমাকে মুক্তি দেয়াটা খুব রিস্কি হয়ে যায়।’ 


রাশিকা হাতজোড় করে বলল, ‘প্লিজ আমাকে ছেড়ে দাও। আমি আমার ভালোবাসার মানুষটাকে শুধু দূর থেকে একবার দেখেই চাকরিতে ইস্তফা দিয়ে এই দেশ ত্যাগ করব।’ 


অজয়ের কণ্ঠস্বর বেঁকে যায়, ‘ভালোবাসার মানুষ? রশিদ কাকাদেরও কি ভালোবাসার মানুষ থাকে?' 


-'খবরদার। আমার এত সুন্দর একটা নামকে তুমি বিকৃত করবে না একদম!' 


-'বিকৃত করছি না, তোমাকে দেখলেই আমার রশিদ কাকার কথা মনে পড়ে। আমাদের স্কুলের দারোয়ান ছিল। দেখতে অবিকল তোমার মতো!'  


রাশিকা ফুটন্ত পানির মতো টগবগ করে ফুটে উঠল রাগে, 'ফালতু কথা বলো না!' 


অজয় স্থির গলায় বলল, ' রশিদ কাকা তোমার মতোই খাটো ছিল। বাবরিকাটা চুল, পুতুপুতু চোখ, টিয়া পাখির মতো লাল ঠোঁট... বডি স্ট্রাকচারও সেম। ' 


-'বডি স্ট্রাকচারও সেম মানে? তুমি জানো আমি কত হট?'  


অজয় ডাকাতিয়া হাসি হাসতে লাগল হো হো করে। যেন এমন মজার কৌতুক এর আগে কখনো শোনেনি। সে নিজেও জানে না তার মনের মেঘ কাটতে শুরু করেছে। গত কয়েকদিনের গুমোট আবহাওয়ায় যেন ফুরফুরে বাতাস লেগেছে। অথচ এই মেয়ের মতো দু:সাহসিক কথাবার্তা রাজ্যের একটি মানুষও তার সাথে বলে না। নিকট বন্ধুরাও না। মনে হচ্ছে জীবনে প্রথমবার কেউ তাকে রাজপুত্র ভেবে না, বরং সাধারণ মানুষ ভেবে কথা বলছে।  


-'হাসছ যে বড়? আমার এত দোষ ধরছ, তুমি নিজে কী? নিজে তো প্রিন্স মন্সটার! গন্ডারের মতো চামড়া, দৈত্যর মতো সাইজ, রাক্ষসের মতো দাঁত!'   


অজয় হাসি থামিয়ে বলল, 'রশিদ কাকার লাভ স্টোরিটা শুনি তো একটু!' 


রাশিকা ভারী সরল গলায় বলল, ‘আমার প্রিন্স চার্মিং। তাকে আমি ভালোবাসি।’ 


-’ভালোবাসা টাসা বলে কিছু নেই পৃথিবীতে। তুমি প্রচণ্ড বোকা একটা মেয়ে।' 


-’ভালোবাসা বলে কিছু থাকবে না কেন? মাথা খারাপ!' 


-’আমার মাথা ঠিকই আছে। তোমারটাই গেছে একদম। ট্রু লাভ একজিজট করে না রিয়েল ওয়ার্ল্ডে। ট্রু লাভ ইজ আ মিথ।’ 


-’কী আশ্চর্য! তোমার কোনও গার্লফ্রেন্ড নেই?’ 


-’গার্লফ্রেন্ড তো আছে শ খানেক। কিন্তু এর সাথে ভালোবাসার সম্পর্ক কী?’ 


-’ছিঃ তুমি এতো বাজে!’ 


অজয় একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে, 'হ্যাঁ আমি এতই বাজে।’  


-’তোমাকে দেখেই বুঝেছিলাম যে তোমার ভেতরটা খটোমটো। তোমার দ্বারা কখনও কাউকে ভালোবাসা হবে না। ট্রু লাভ এই পৃথিবীতে আছে ঠিকই, নেই শুধু তোমার মনে। আমার প্রিন্স চার্মিং ওরকম নয়, আমি জানি!’ 


-’তোমার প্রিন্স চার্মিংটা কে শুনি? আমার ভাই-রাজা নয়তো?' 


রাশিকা লজ্জায় লাল টাল হয়ে অপরাধী গলায় বলল, ‘হুম।’ 


অজয় হাসে, ডাকাতিয়া অট্টহাসি। 


-’হাসির কী হলো?’ 


-’আমার ভাইয়ের পেছনে মেয়েদের কত লম্বা লাইন তুমি জানো? কোনও চান্স নেই! আশা ছেড়ে দাও।’ 


-’চান্স লাগবে না। আমি শুধু তাকে দূর থেকে একবার শান্তি মতো দেখব। তারপর চম্পট দিব নিজের দেশে। আমাকে তুমি ছেড়ে দাওগো রাক্ষস কুমার! পায়ে পড়ি!'  

 

অজয় মাথা নাড়ে, ‘অসম্ভব! এখন তোমাকে ছাড়া যাবে না কিছুতেই। পরিস্থিতি কোনদিকে যায় সেটা আগে দেখবার বিষয়। পুলিশ যদি লাশটা খুঁজে পায় তাহলে ইনভেস্টিগেশন হবে। কেউ ঘটনাটা দেখে থাকলে হয়তো সরাসরি আমার নামে মামলাও করে বসতে পারে। তোমার সাক্ষ্য আমার প্রয়োজন হবে যেকোনো মূহুর্তে।’ 


-’কিন্তু আমার চাকরির কী হবে? আমার বাবা মাকে আমি কী বলব?’ 


-’কাউকে কিছু বলার প্রয়োজন নেই। তুমি আমার বন্দি।’ 


-'কেউ জানতে পারলে?' 


-'ও নিয়ে তোমাকে ভাবতে হবে না। আমি সামলে নেব। ' 


রাশিকা নাছোড় গলায় বলল, ‘কিছুতেই থাকব না এখানে! কিছুতেই না!’ 


-’ভুলে যেও না আমি তোমাকে গতরাতে রক্ষা করেছিলাম।' 


-’তো হয়েছেটা কী? মাথা কিনে নিয়েছ?’ 


অজয় নির্লিপ্ত গলায় বলে, ‘শুধু মাথা না, পুরো তোমাকেই কিনে নিয়েছি।’    


রাশিকা 'আমাকে কেনা অত সোজা না' বলে চোখ বন্ধ করে ছুট দিল দরজার দিকে। অজয় খপ করে ধরে ফেলল ওর হাত। খিঁচে টেনে আনল নিজের দিকে। ঠাণ্ডা শিরশিরে গলায় বলল, ‘চিৎকার করলে একদম গলা কেটে দেব খ্যাচ করে।’ 

রাশিকা চিৎকার করল না কিন্তু অজয়ের চওড়া বুকের ওপর এলোপাতারি কিল ঘুষি মারতে থাকল। অজয় এবারে ওর দুটো হাতই চেপে ধরল। চাপা রাগে গর্জন করে উঠে বলল, ‘সমস্যা কী তোমার? মাথায় কি বুদ্ধি বলতে কিছুই নেই? তুমি কি বুঝতে পারছ না তোমাকে আমার প্রয়োজন? তুমি কি বুঝতে পারছ না কত বড় বিপদে পড়েছি আমি তোমাকে বাঁচাতে গিয়ে?' 


রাশিকা দমল একটু, ‘প্রয়োজন হলে ঠিক মতো অনুরোধ করতে হয়। আদেশ দিতে হয় না।’ 


-’আমি অনুরোধ করতে পারি না। হুকুম করতে পারি।’ 


-’আমি হুকুম মানি না। অনুরোধ করলে ভেবে দেখব।’ 


অজয় হতাশ হয়ে ছেড়ে দিল রাশিকাকে। নিরুপায় গলায় বলল, ‘ ইম্পসিবল একটা মেয়ে তুমি!' 


রাশিকা বলল, ‘তোমাকে সাহায্য করতে পারি এক শর্তে।’ 


-’কী শর্ত?’  


-’তুমি তোমার ভাইয়ের সাথে আমার ডেট ফিক্স করে দেবে। অতি শীঘ্র।’ 


অজয় তাচ্ছিল্যের হাসি হাসল, ‘সিরিয়াসলি? মানুষের জীবন মরণ সমস্যা আর তুমি আছ ডেটিং করার ধান্ধায়।’ 


-’ভালোবাসার মূল্য জীবনের থেকে কোনও অংশেই কম নয়। তুমি এসব বুঝবে না। শর্তে রাজি আছ কিনা বলো।’ 


-’ওকে … । এটা কোনও ব্যাপারই না।’ 


রাশিকার চোখ দুটো অনেক ক্ষণ বাদে ঝলমল করে হেসে উঠল, ‘সত্যি?’ 


-’হুম, সত্যি। তবে ডেটে গিয়ে আবার ভালোবাসা দাবি করে বসো না যেন।’ 


রাশিকা হাসতে লাগল, ‘নাহ ...ভালো তো তাকে আমি বাসি। সে তো বাসে না। এসব জোর করে হয় নাকি!’ 


-’ঠিক আছে। তুমি মহলের বাইরে যাবে না। মনে থাকে যেন।’ 


একজন ভৃত্য দরজা নাড়ছে। অজয় এগিয়ে গিয়ে দরজা খুলতেই কুর্ণিশ করে বলল, ‘মাননীয় রাজকুমার, বিরক্ত করার অন্য ক্ষমা করবেন। নিচে রাজকন্যা এবং ছোট কুমার এসেছেন আপনার দর্শন লাভের উদ্দেশ্যে।’ 


-’আসছি। তুমি যাও।’ 


দরজার চৌকাঠে দাঁড়িয়ে থেকেই অজয় রাশিকাকে বলল, ‘ এই ঘর থেকে বেরোবে না। তালা না দিয়ে ভরসা করলাম তোমার ওপর। ' 


-’শোনো, আমি এখানে একা একা বসে থাকতে পারব না। আমি কিন্তু খুব ভালো রান্না করি। তুমি বরং আমাকে রান্না করার সুযোগ দাও। সময় কাটবে আমার। টাকা দিতে হবে না। ফ্রিতেই করে দেব। আমার রান্না খেয়ে মুগ্ধ হবে।’  


-‘আমি কিছুই খেতে পারছি না কদিন ধরে।’ অজয় অবাক হয়ে আবিষ্কার করল এই মেয়েটার সাথে সে যতটা সহজে মনের সব কথা উজাড় করে দিতে পারছে, এতটা সহজে কোনদিন আপন অন্তরাত্মার কাছেও নিজেকে মেলে ধরতে পারেনি। আশ্চর্য!  


-’আমার রান্না খেয়ে তুমি পাগল হয়ে যাবা রাক্ষসকুমার! আই প্রমিজ!’  


-’তাই নাকি?’ 


-’হ্যাঁ ঠিক তাই।’ 


-’আর যদি তুমি ভুল প্রমাণিত হও? যদি তোমার রান্না আমার মুখে না রোচে?’  


-’তাহলে তুমি যা বলবে আমি তাইই করব।’ 


-’ডিল অন?’ 


-’হান্ড্রেড পার্সেন্ট অন।’ এটুকু বলে রাশিকার যেন হঠাৎ মনে পড়ল, ‘আচ্ছা, আমার জামা পাল্টেছে কে?’ 


অজয় দ্বিধাহীন কণ্ঠে বলল, ‘আমি!’ 


-’হোয়াট?’ এক ধাক্কায় হৃৎপিণ্ডটা গলার কাছে চলে এলো। অজয় অবিচলিত দৃঢ় কণ্ঠে বলল, ‘এত চমকাবার কী আছে? তোমার জামায় রক্ত লেগে ছিল। কেউ দেখে ফেললে কী হত? অ্যান্ড ইউ ওয়্যার উন্ডেড। তোমার ক্ষতস্থান থেকে রক্ত ঝরছিল। ব্যান্ডেজ প্রয়োজন ছিল।’ 


রাশিকার চোখ দুটো মার্বেলের মতো গোল হয়ে গেছে। মুখে হাত দিয়ে স্তম্ভিত ভাবে দাঁড়িয়ে আছে সে। দেখে মনে হচ্ছে এইমাত্র যেন সর্বনাশ হয়ে গেছে। অজয় বলল, ‘আমি নিরুপায় হয়ে কাজটা করেছি। শখে করিনি! তাছাড়া রক্ত ক্লিন করাটা প্রয়োজন ছিল। আমার আজকাল রক্তের গন্ধে সমস্যা হয়। অনেক দূর থেকেও রক্তের গন্ধ টের পাই।’  


রাশিকা অবাক হলো, ‘এটার মানে কী? তুমি কি মানুষ? নাকি অন্যকিছু?’ 


অজয় কেমন স্তব্ধ হয়ে যায় প্রশ্নটা শুনে। চোখে একটা কালো ছায়াপাত ঘটে। দ্বিধার রেখা ফুটে ওঠে কপালে। খুব ক্ষীণ গলায় বলে, ‘জানি না!’  


-------------- 


এই লেখা কেউ কপি করবেন না। যদি আমার অনুমতি ব্যতীত আমার লেখা কোথাও পোস্ট করা হয় তবে আইনগত ব্যবস্থা নেয়া হবে। কপি কারীকে আমার লইয়ার সরাসরি লিগ্যাল নোটিশ পাঠাবে।

No comments

Powered by Blogger.