গল্প | উড়ান মেঘের দেশে - পর্ব-১৫ | Oran megher deshe - Part-15
লেখিকা-ওয়াসিকা নুযহাত

তুর্যয় আয়েশি ভঙ্গিতে পায়ের ওপর পা তুলে বসেছে। চোখে রোদ চশমা। ঈষৎ গোলাপি ওষ্ঠদ্বয়ে লেগে আছে দুরন্ত এক প্রাঞ্জল হাসির রেশ। মনের আনন্দে পা নাচাচ্ছে আর শিস বাজাচ্ছে।
তার ভেতরে ক্ষণকাল পূর্বের গুমোট ভাবটা এখন অনুপস্থিত। লিমোজিনের দরজা বন্ধ হবার সঙ্গে সঙ্গে যুবরাজ সুলভ গাম্ভীর্য যেন ফুৎকারে উড়ে গেছে। জানালার কাচে দৃষ্টি নিবদ্ধ থাকলেও, মুখোমুখি বসা মানুষটাকে আড়চোখে দেখছিল মেহেরু। গলার কাছে একটা অস্বস্তির কাঁটা লেগে আছে। শান্তিতে দম ফেলতে পারছে না। ভেতরে ভেতরে মোচড়ানো কাগজের মতো কুঁকড়ে গেছে। রাগও হচ্ছে প্রচণ্ড। পিচ্চি একটা ছেলের সামনে কুণ্ঠায় জমে যাওয়ার মতো আন্সমার্ট সে কবে থেকে হল? যুবরাজ হয়েছে বলে কি মাথা কিনে নিয়েছে? এইতো মাত্র সেদিন অংকে ভুল করে কান মলা খেয়েছিল মেহেরুর হাতে। দস্যি ছেলেটা কি ভুলে গেছে সব? এখন এমন ভাবে পা দুলিয়ে শিস বাজাচ্ছে যেন মেহেরু একজন অচেনা কিশোরী বালিকা। ভদ্রতার বালাই নেই। দুর্বিষহ ভাবনা গুলো থিতিয়ে থিতিয়ে মগজে বসে যাচ্ছিল একদম। মেজাজ চড়ে যাচ্ছে সপ্তমে। মিথিলার পড়াটা শেষ হলে সে নির্ঘাত এই দেশ ছেড়ে চলে যাবে।-’আপনি চাইলে আমার দিকে সরাসরি তাকাতে পারেন। চুরি করে দেখার কোনও মানে হয় না!’ ঠোঁটে ঝকঝকে প্রাঞ্জল হাসি নিয়ে নির্বিকার গলায় বলল তুর্যয়। মেহেরু ঢোঁক গিলে দাঁতে দাঁত চেপে রাগটাকে দমন করল। তারপর ঘুরে তাকিয়ে স্পষ্ট গলায় বলল, ‘আপনি চাইলে সরাসরি অনুরোধ করতে পারেন, মানে আমাকে বলতে পারেন, এদিকে একটু তাকান প্লিজ! মিছিমিছি আমার ওপর চুরির দায় চাপানোর কোনও মানে হয় না।’
তুর্যয়ের মুখ থেকে হাসির রেশ হারায় না। ঠোঁট টেনে বলে, ‘স্মার্ট! তবে আমি আজকাল অনুরোধ করি না। আদেশ করি।’
-’চমৎকার উন্নতি হয়েছে আপনার মাননীয় যুবরাজ! ব্রাভো!’ কথাটা বলে মেহেরু আবারও জানালার বাইরে চোখ রাখল।
-’শুনুন, এদিকে তাকান।’
অনিচ্ছা স্বত্বেও হুকুম তামিল করল মেহেরু।
-’লেইট করলেন কেন?’
-‘মায়ের শরীর খারাপ ছিল।’ মিথ্যের আশ্রয় নিতে হল বাধ্য হয়ে।
-’কী হয়েছে উনার?’
-‘এইতো ... ব্রিদিং প্রব্লেম। অ্যাজমার সমস্যা আছে।’
-এখন কেমন আছেন?’
-’বেটার।’
-’ও, আমি ভেবেছিলাম আপনি চাকরিটা করতে চাইছেন না।’
মেহেরু তেরছা হেসে বলল, ‘না চাইলেও তো চাকরিটা আমাকে করতেই হবে, তাই না? অন্য কোনও উপায় তো নেই!’
-’ঠিক বলেছেন, অন্য কোনও উপায় নেই। আমি আদেশ অমান্য করা পছন্দ করি না। আমার রাজ্যে আদেশ আমান্যকারীর ভয়াবহ শাস্তি হয়।’
মেহেরু কড়া চোখে তাকাল। ছেলেটা এতো বেয়াদব হয়েছে কবে থেকে? আগেও চটাং চটাং কথা বলত কিন্তু এহেন আকাশস্পর্শী অহংবোধ এবং জাহাঁবাজ ভাব তো ওর মধ্যে কখনও ছিল না! একটা উৎকট রাগে মেহেরুর ভেতরটা থমথম করছিল। তুর্যয় এখনও পা নাচাচ্ছে। চশমা ঢাকা চোখ নিয়ে চেয়ে আছে মেহেরুর দিকে। সকালের সুবর্ণ আভাযুক্ত আলো জানালার দামি কাচ ভেদ করে ছুঁয়ে দিয়েছে ওর টকটকে ফর্সা কপাল, ফুরফুরে হালকা গোলাপি ঠোঁট, কুচকুচে কালো জোড়া ভ্রু আর চাপ দাড়ি। সে মনের আনন্দে শিস দিচ্ছে। দুষ্টু দামাল হাসিটা হেসেই যাচ্ছে অনবরত। আগে এই হাসি মেহেরুর আদর লাগত। এখনও আদুরে, কিন্তু কীরকম একটা ধূর্ততার প্রলেপ যুক্ত হয়েছে বলে মনে হচ্ছে। নাকি মেহেরুর মনের ভুল? সে বিরক্ত গলায় প্রশ্ন করল,-’হাসছেন কেন?’
-’ভালো লাগছে ... তাই হাসছি।’ নির্বিকার স্বীকারোক্তি তুর্যয়ের। এই নির্বিকার ভাবটাই বোধহয় ওর ব্যক্তিত্বে আলাদা একটা চার্ম যোগ করে। ঝলমলে উজ্জ্বল! কিন্তু হালকা নয়, বরং সপ্রতিভ, কুশলী এবং অপরিসীম সাহসী!
-’ভালো লাগার কী হলো হঠাৎ?’ বিপর্যস্ত শোনায় মেহেরুর গলার স্বর।
তুর্যয় চশমা খুলে নিল। ভাসা ভাসা ধূসর চোখজোড়া মেহেরুর মুখের ওপর তাক করে প্রসন্ন গলায় বলল, ‘কেন? আপনার ভালো লাগছে না?’
স্বচ্ছ দুটি চোখের ওপর নজর পড়তেই মেহেরু অনেকদিন আগে হারিয়ে যাওয়া দরজাটা যেন এক ঝলক দেখতে পেলো, যে দরজার বাইরে তার জন্য একটা আলাদা আকাশ আছে! ওই দৃষ্টি দেখেই সে বুঝল সামনে বসা যুবকটি আদতে একটুও বদলায়নি। মুখে যত বড় বড় কথা বলুক না কেন, ওর ভেতরটা শিশুর মতো সরল। তাকে উত্যক্ত করার জন্যই ইচ্ছাকৃত ভাবে অসদাচরণ করছে। ভেবেছে দুর্ব্যবহার করে পাঁচ বছর আগের অপমানের শোধ নেবে। কী ছেলেমানুষি চিন্তা! মেহেরু কোনও প্রত্যুত্তর করল না। জানালার বাইরে চোখ সরিয়ে নিতে নিতে খুব মিহি ভাবে টের পেল এইসব বিরক্তি মিশ্রিত কপট রাগের পেছনে মনের অনেক তলানিতে সত্যিই ভালো লাগার একটা রঙিন প্রজাপতি ধীরেধীরে পাখনা মেলে উড়বার প্রস্তুতি নিচ্ছে। তার যান্ত্রিক কর্মময় চাকরবৃত্তি সম্পন্ন জীবন অলিন্দে আজ বহুদিন পর এক ফালি সূর্যের আলো এসে পড়েছে। সেই সাথে অভিমানের একটা বিস্মৃত সুরও যেন ফিরে এসেছে গুনগুন করে। তুর্যয় কেন কিছু না বলে চলে গিয়েছিল? যাবার পর আর একটাবার খোঁজ নেয়নি। কেমন ছিল মেহেরু এতকাল এই কথাটাও জানার চেষ্টা করেনি। যদি মরে যেত? যদি আর কখনও কোনওদিন দেখা না হতো? হঠাৎ দুর্বোধ্য কুয়াশার ভেতর থেকে যেন খুব সন্তর্পণে একটা বাস্তব সত্য দৃশ্যমান হয়ে উঠল। সে জানল, বিগত কয়েক বছর ধরে অবচেতন মনে সে এই কাঙ্ক্ষিত মুহূর্তটির ছবি এঁকেছে বহুবার। ভীষণ ভাবে চাইছিল আর একবার দেখা হোক, অন্তত আর একটিবার!
তুর্যয় চুপ করে চেয়ে মেহেরুর মুখের স্বর্গীয় লাবণ্য প্রত্যক্ষ্য করছিল। কপালের কাছে কয়েকটা চুল এসে পড়েছে। সেই চুলে রোদের আভা লাগায় চকচক করছে সোনার মতো। জাম রঙের সাধারণ শাড়ি, ফুল হাত ব্লাউজ, গলায় কানে কোনও অলঙ্কার নেই, নেই প্রসাধন। লম্বাটে মুখ, ছিপছিপে গলদেশ, স্পর্ধিত গ্রীবা, নিখুঁত কন্ঠাস্থি...পৃথিবীতে কিছু সৌন্দর্য থাকে বর্ণণার অতীত। মেহেরুর মসৃণ চকচকে ত্বকের খাঁজে খাঁজে যে অলোকসামান্য রুপের প্রভা বিরাজমান, সেই প্রভাটুকু পুঙ্খানুপুঙ্খু ভাবে ফুটিয়ে তোলা পৃথিবীর কোনও শিল্পী, কোনও কবি বা সাহিত্যিকের দ্বারাই সম্ভব নয়। ওই রুপ মানুষের জ্ঞান বুদ্ধি এবং সৃষ্টিশীলতার ধরা ছোঁয়ার বাইরে, অনির্বচনীয় এর প্রকাশ … অভিনব নজিরবিহীন এর ভঙ্গি, যে চোখের দেখা দেখেনি সে কোনদিনও জানবে না এই নারীর স্বরূপ কী!
তুর্যয়ের আসলেই খুব ভালো লাগছিল। এতো বেশি ভালো লাগছে যে সারা পৃথিবীকে চিৎকার করে এই ভালো লাগার কথা জানাতে ইচ্ছে করছে। এমনকি পাঁচ বছর আগের প্রত্যাখ্যানটুকু, অপমানটুকুও সে এই মুহুর্তে ভুলে গেছে। জানালার বাইরে থইথই করা সোনালি রৌদ্র লহরে ভাসছে সমুদ্রকুঞ্জর রাজপথ আর গাড়ির কামরায় খুব কাছাকাছি, মুখোমুখি বসে থাকা তার জীবনের প্রথম প্রেম! এমন ব্রাহ্ম মূহুর্ত বুঝি আর হয় না। চারপাশটা কেমন কবিতার মতো স্নিগ্ধ। প্রিয় স্বদেশ, প্রিয় নারী এবং প্রিয় কবিতা এই তিনটি বস্তু যেন একই গানের স্তবকে বাঁধা কোনও মোহময় সুর।
-’চুপ করে আছেন কেন?’
মেহেরু ঘাড় ঘুরিয়ে তাকায়, ‘কী বলতে হবে? মাননীয় যুবরাজ?’
-’মাননীয় যুবরাজ সম্বোধনটা একটু কেমন যেন। অন্য কিছু ডাকুন।’
মেহেরু গলায় কপট আনুগত্যের ছাপ ফুটিয়ে বলল -’কী ডাকব? মাই লর্ড, ইওর ম্যাজেস্টি ...নাকি ডক্টর তুর্যয়?’
-’ইওর ম্যাজেস্টি সাউন্ডস গুড। বাট ডক্টরেট হয়নি এখনও। সামনের মাসে ডিফেন্স। অনলাইনে হবে।’
শুনে মেহেরুর মনটা একটু খারাপ হলো। এরকম একটা সময়ে মহারাজের অসুখ ধরা পড়ল যে তুর্যয়কে মাঝপথে পড়াশোনায় বিঘ্ন ঘটিয়ে দেশে ফিরতে হলো। আর একটা মাস পর এই ঝামেলাটা হলে কী এমন ক্ষতি হত? গাড়ি থেমেছে মহলের সামনে। দরজা খুলে গেছে আপনাআপনি। দরজার সামনে দাঁড়িয়ে আছে তুর্যয়ের দেহরক্ষী এবং ড্রাইভার। মেহেরুর সংকোচ হচ্ছিল। ওই সীমাহীন বিব্রতকর পরিস্থিতিতে তুর্যয় ফট করে বলে বসল, ‘আপনি তো এখনও বিয়ে করেননি, তাই না?’
মেহেরু লজ্জায় কুণ্ঠায় মরমে মরে গেলো। মুখে কালিমার ছায়াপাত ঘটল। বাইরের লোকের সামনে ব্যক্তিগত বিষয় টেনে আনার মতো অসভ্যতা আর হয়? তুর্যয় ড্যামকেয়ার। কোনও হুঁশই নেই ছেলেটার। এতদিন পর মানসপ্রিয়ার সাক্ষাৎ পেয়ে বুঝি সে পাগল হয়ে গেছে।
মেহেরু কোনরকমে মাথা নেড়ে বলল, ‘না!’
তুর্যয়ের ঠোঁটে দামাল হাসিটা ফিরে আসে, ভ্রু নাচিয়ে কী রকম একটা অন্যরকম মুখোভঙ্গি করে সকৌতুকে বলে, ‘কেন? কারো জন্য ওয়েইট করছিলেন নাকি?’ কথাটা ছুঁড়ে দিয়ে আর এক মুহূর্তও সময় নষ্ট না করে মহলে প্রবেশ করল সে। এদিকে মেহেরুর দশা হয়েছে চুপসে যাওয়া বেলুনের মতো ন্যাতা ন্যাতা। লোকে কী ভাববে? ছিঃ মাটির নিচে অদৃশ্য হয়ে যেতে মন চাইছে। বদনামটা তো তাকে ঘিরেই হবে। তুর্যয়ের তো কিছু হবে না!
মহলে ঢুকতেই দু তিনজন চাকর দৌড়ে এলো। একজন শরবত এগিয়ে দিল তুর্যয়ের দিকে। তুর্যয় খুব সাবলীল গলায় বলল, ‘ধন্যবাদ। কিন্তু আমার এখন এসব চাই না।’
রাজবাড়ির চাকররা মনিবদের কাছ থেকে ধন্যবাদ পেয়ে অভ্যস্ত নয়। বিলেতে গিয়ে তুর্যয় শিখেছে ছোট বড় সব কাজের জন্য হাসিমুখে কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করতে হয়। ফিরে আসার পর থেকে সব বয়সী, সব স্তরের মানুষের সাথে সে দেখা হওয়া মাত্র কুশল বিনিময় করছে, কথায় কথায় ধন্যবাদ দিচ্ছে। এই বিনয় দেখে প্রাসাদের কর্মচারিরা মুগ্ধ।
তুর্যয় বলল, ‘শরবতটা উনাকে দিন। ‘ চাকর ছেলেটা একটু বিব্রত হল। কথাটার অর্থ বোধহয় বুঝল না। শরবত পরিবেশন করার মতো গণ্যমান্য কাউকে সে আশেপাশে দেখতে পাচ্ছে না। রাজপুত্রের দেহরক্ষী এবং অন্দরমহলের কর্মচারি মেহেরু ব্যতীত কোনও সম্মানিত অতিথির উপস্থিতি নেই এখানে। চাকরটি তটস্থ গলায় বলল, ‘কাকে হুজুর?’
তুর্যয় মেহেরুর দিকে ইঙ্গিত করে বলল, ‘উনাকে!’
মেহেরুর ফর্সা গাল লজ্জায় লাল টুকটুক হয়ে উঠল। বিপন্ন ভাবে বলল, ‘না না! আমার শরবত চাই না।’
একজন চাকর তুর্যয়ের পরনের কোট খুলে হাতে নিয়েছে। আরেকজন দাঁড়িয়ে আছে পায়ের জুতো খুলে দেয়ার সংকল্প নিয়ে। সেই সুযোগ না দিয়ে তুর্যয় মেহেরুকে বলল, ‘আমার সাথে আসুন।’
মেহেরুর ভয় করছিল। তার মতো সাধারণ কর্মচারির প্রতি যুবরাজের এই আদিখ্যেতা কেউ স্বাভাবিক ভাবে নেবে না। এর পরিণাম কী হবে? হঠাৎ মনে পড়ল বেলা বারোটায় রানিমা মূল রাজভবনে উপস্থিত থাকতে বলেছেন। বড় রাজপুত্রের আগমন উপলক্ষে ব্রাহ্মণ ভোজ হবে। মেহেরুকে দাসীদের সঙ্গে অবস্থান করে গরিব ব্রাহ্মণদের সেবা করতে হবে। কিন্তু তুর্যয়ের হাত থেকে নিষ্কৃতি পাওয়া কি আদৌ সম্ভব? দুশ্চিন্তায় তার কপাল বেয়ে ঘাম ঝরতে লাগল।
মহলের কাছারি ঘরে উপদেষ্টা কমিটির সদস্যরা অপেক্ষা করছিল। আজকে তুর্যয়ের নিজের কলেজে সংবর্ধনা অনুষ্ঠান আছে। বিকেলে আছে প্রেস কনফারেন্স। উপদেষ্টা কমিটির সাথে এই সভাও কম গুরুত্বপুর্ণ নয়। কাছারি ঘরের পাশেই যুবরাজের দপ্তরখানা। গোলাকার, সুপ্রশস্ত এবং খোলামেলা। কাচ ঘেরা দেয়ালের ওপাশে ঘন সবুজ আম্রকুঞ্জ। আম বাগানে এর মাঝেই চিত্রশালা গড়া হয়েছে। রাজকুমারের যখন কাজে মন বসবে না তখন ছায়া ঘেরা বাগানে বসে ইচ্ছেমতো ছবি আঁকবে। চিত্রশালার নকশাটা ভারী নজরকাড়া। জাপানি ভদ্রলোক ডিজাইন করেছে। দেখলে চোখ জুড়িয়ে যায়। চিত্রশালার পাশেই সুবিশাল আম গাছের ডাল থেকে ঝুলছে একটি রুপোর হাতলওয়ালা দুই গদি বিশিষ্ট ঝুলন। ঝুলনের দড়িতে লাল সাদা ফুল জড়ানো। মনে হয় যেন স্বর্গদ্যানের দেবতাদের জন্য তৈরি করা হয়েছে এই বিশেষ দোলনা। কাছারি ঘরে দশ সদস্য বিশিষ্ট একটি দল বসে আছে। রাজকুমার কে দেখে সকলেই উঠে দাঁড়িয়ে কুর্নিশ করল। তুর্যয় অভিবাদন জানিয়ে নিজের অফিসঘরে ঢুকে পড়ল। মেহেরু অনুসরণ করছিল ওকে। ঘরের সবকিছু নতুন এবং ঝকঝকে। বিলাসিতার অতিশজ্যে দম বন্ধ হয়ে আসার উপক্রম।
টেবিল সংলগ্ন রিভলভিং চেয়ারটা টেনে বসল তুর্যয়। মেহেরুর দিকে চেয়ে বিস্মিত গলায় বলল, ‘ভয় পাচ্ছেন কেন?’
মেহেরু বিব্রত হলো , ‘কই? ভয় পাচ্ছি না তো!’
-’আপনাকে দেখে মনে হচ্ছে জীবন মরণ পরীক্ষা দিতে এসেছেন। সমস্যা কী?’
মেহেরু দাঁড়িয়ে থাকা অবস্থায় নিয়োগপত্রটা তুর্যয়ের দিকে এগিয়ে দিয়ে বলল, ‘কিছু প্রশ্ন ছিল।’
-’কী প্রশ্ন?’
মেহেরু সংকুচিত ভাবে বলল, ‘এখানে স্যালারি উল্লেখ করা হয়নি।’
-’কত টাকা চাই আপনার?’
-‘যেটা ন্যায্য, সেটাই দেবেন।’
-’ন্যায্য অন্যায্যর কিছু নেই। আপনার ইচ্ছে মতো একটা সংখ্যা বসিয়ে নিয়েন। ‘
বিস্ময়ে কাদা হয়ে গেলো মেহেরু -’কী আশ্চর্য! কেন?’
তুর্যয়ের মুখ থেকে হাসির রেশ এখন মুছে গেছে। কপালে ফুটে উঠেছে কয়েকটা উদ্বেগ জনিত ভাঁজ। সে শক্ত মুখে বলল, ‘আমি বলেছি, তাই।’
-’এর বিনিমিয়ে আমার কাজটা কী হবে?’
তুর্যয় রিভলভিং চেয়ারের পিঠে হেলান দিয়ে বলল, ‘দেখুন আপনি তো জানেন আমি সরাসরি কথা বলতে ভালোবাসি। অনেস্টলি স্পিকিং, আপাতত আপনার একমাত্র কাজ হলো আমাকে সঙ্গ দেয়া।’
একটা চাপা রাগে রিরি করে উঠল মেহেরুর সারা শরীর। অত্যন্ত কঠিন গলায় বলল, ‘এটা কেমন কথা? কোনও কাজ না করে আমি মাসে মাসে টাকা নেব কেন?’
-’কাজ থাকবে না কেন? বললাম তো আপনার কাজ আমাকে সঙ্গ দেয়া।’ তুর্যয়ের কণ্ঠস্বর নির্বিকার এবং বরফের মতো নিঃস্পৃহ।
মেহেরু অনেক কষ্টে ক্রোধ সংবরণ করে বলল, ‘দেখুন, আমি জানি আপনি রাজ্যের যুবরাজ। আপনার আদেশ অমান্য করার সাধ্য আমার নেই। কিন্তু আমি দুঃখিত। এই অনৈতিক কাজ করা আমার দ্বারা করা সম্ভব হবে না। আমি শ্রমের বিনিময়ে পয়সা নেব। সময়ের বিনিময়ে নয়।’ ’
সেকেন্ড না গড়াতেই ম্যাচের কাঠির মতো ভস করে জ্বলে ওঠে তুর্যয়ের ধূসর দুটি চোখের তারা। যেন চোখ নয়, সাক্ষাৎ অগ্নিকুণ্ড! মনে পড়ল বছর পাঁচেক আগে এই মেয়েটা তাকে ধাক্কা দিয়ে পুকুরের জলে ফেলে দিয়েছিল। সেই অপমান এখনও ভুলতে পারেনি। আজকে এতদিন বাদে যেন অতীতের ঘটনার পুনরাবৃত্তি হচ্ছে। ঝরো বাতাসের মতো শোঁশোঁ শব্দে বুকের মধ্যে ফিরে আসছে পুরনো কলঙ্ক এবং অবমাননার গ্লানি। সে তুষারস্পর্শী শীতল গলায় বলল, ‘আপনার মতামত কেউ জানতে চায়নি। আপনাকে হুকুম করা হয়েছে। আপনি হুকুম পালনে বাধ্য।’
রাগে কান্না পাচ্ছিল মেহেরুর। দাঁত দিয়ে ঠোঁট চেপে ফ্যাসফ্যাসে গলায় বলল, ‘আপনি আমাকে অপমান করছেন।’
তুর্যয় কাষ্ঠ হাসি হাসে, ‘অপমান করার অধিকার কি শুধু আপনার একারই আছে ভেবেছিলেন?’
-’আমি যাচ্ছি!’ শব্দ দুটো উচ্চারণ করে মেহেরু ঘুরে দাঁড়ায়। পেছন থেকে বজ্রকঠিন হুঙ্কার ছুটে আসে, ‘কোথাও যাবেন না! চুপ করে বসুন। নইলে খুব বড় ক্ষতি হবে বলে দিচ্ছি!’
মেহেরু সর্পিণীর মতো ফুঁসে ওঠে, ‘কী ক্ষতি হবে? গর্দান নেবেন?’
-’প্রয়োজনে তাই নেব। শুধু আপনার না। আপনার মা বোনেরও গর্দান যেতে পারে এই অবাধ্যতার কারণে। মাইন্ড ইট!’
কান্নার দমকে মেহেরুর ঠোঁট কাঁপতে লাগল। আজকে গরিব হয়েছে বলে হাঁটুর বয়সী একটা ছেলের কাছে অপমানিত হতে হচ্ছে। সংসারের পিছুটান না থাকলে এই মুহূর্তে সে আত্মহত্যা করত। সত্যি এখন একদম মরে যেতে মন চাইছে! কী অসহ্য একটা জীবন তার! এই জীবনকে সে ঘেন্না করে!
তুর্যয় আবারও হাঁক ছাড়ল, ‘কথা কানে যায় না? বসতে বলেছি।’
মেহেরু রাগে গজগজ করতে করতে চেয়ারে বসল। তারপর গরম তেলে পেঁয়াজ ছাড়ার মতো ছ্যাঁত করে ঝলসে উঠে বলল, ‘বসলাম! এখন কী করতে হবে?’
-’আপনাকে কিছু করতে হবে না। যা করার আমিই করব।’
-’কী করবেন তা কি জানতে পারি? ইওর ম্যাজেস্টি!’ ঝাঁঝালো গলায় বলে মেহেরু।
-‘নিশ্চয়ই জানতে পারেন।’ কথাটা শেষ করে তুর্যয় বসা থেকে উঠে দাঁড়ালো। হেঁটে এগিয়ে গেলো কফি মেশিনের দিকে। কালো কুচকুচে জোড়া ভ্রু দুটো নাচিয়ে নির্বিকার গলায় বলল, ‘এখন আমি কফি পান করব আর আপনাকে দেখব।’
চমকে ওঠে মেহেরু -’মানে কী?’
-’যা বলার একবারই বলেছি। বারবার বলব না।’
-’আপনি লিমিট ক্রস করছেন।’
-’রাজা মহারাজাদের ডিকশনারিতে লিমিট নামের কোনও ওয়ার্ড থাকে না।’
-’বাইরে আপনার জন্য লোকজন অপেক্ষা করছে।’
-’ও নিয়ে আপনাকে ভাবতে হবে না।’
মেহেরু যার পর নাই অস্বস্তি নিয়ে চেয়ারে কাঠ হয়ে বসে রইল। ভয়ে তার অন্তরাত্মা শুকিয়ে আসছে। এই পাগলের হাত থেকে নিস্তার পাবে কী করে? একটা বিষয় স্পষ্ট যে তুর্যয় পাঁচ বছর আগে ঘটে যাওয়া ঘটনার শোধ তুলতে চাইছে। কে বোঝাবে ওকে যে মেহেরু ইচ্ছাকৃত ভাবে কিছু করেনি। জঙ্গল থেকে ছুটে আসা পদশব্দ শুনতে পেয়ে একরকম বাধ্য হয়ে কাজটা করতে হয়েছিল। তুর্যয় কি সেই শব্দ শুনতে পায়নি? নাকি মেহেরুর অতিপ্রাকৃত ক্ষমতাধর কানই শুধু শব্দটা শুনতে সক্ষম হয়েছিল? এখন পুরনো কথা তুলতে যাওয়াও বোকামি হবে। কী করবে সে? বাইরের ঘরে বসে থাকা মানুষগুলো যদি মহারাজের কানে কোনও অসঙ্গত কটু কথা তুলে দেয়?
তুর্যয় কফির মগ হাতে নিয়ে চেয়ারে এসে বসল। তারপর একটা শব্দও উচ্চারণ না করে নির্দ্বিধায় অপলক স্থির দুটি চোখ স্থাপন করল মেহেরুর মুখের ওপর। অস্বস্তি, কুণ্ঠা আর ভীতির সঞ্চারে মেহেরুর সারা শরীর অসাড় হয়ে আসছিল। মাথা হেঁট করে পাথর হয়ে রইল সে। হঠাৎ মনে হল এই মুহূর্তে জাদুর প্রয়োগ না করলেই নয়। তুর্যয়কে তার সম্মোহন করতে হবে। ঘরে যেহেতু তৃতীয় ব্যক্তির উপস্থিতি নেই,সম্মোহন করা কোনও কঠিন ব্যাপার হবে না। ভাবনাটা মাথায় আসতেই চোখ তুলে তাকালো। সম্মোহনের জন্য প্রথমে নিজের মন কেন্দ্রীভূত করতে হয়, তারপর মনোযোগ সহকারে পড়তে হয় মন্ত্র। কিন্তু ওই ভাসা ভাসা দুটি চোখের দিকে চাওয়া মাত্রই তার মন বাঁধা পড়ল গভীরতার নিশ্ছিদ্র এক জালে। রক্তে খেলে গেলো তরঙ্গ। সাদা কালো হৃদয়ের বিষণ্ণ ক্যানভাসে বিচ্ছুরিত হতে থাকল রঙের ফুলঝুরি। ভেতর থেকে যেন বাকবাকুম করে ডেকে উঠল একটা পায়রা। সম্মোহন করার বদলে সে নিজেই কেমন সম্মোহিত হয়ে পড়ল। পৃথিবীতে এই একটা মাত্র মানুষ, যাকে মেহেরু কোনও দিন জাদুশক্তি দ্বারা নিয়ন্ত্রণ করতে পারেনি। কখনও পারবেও না হয়তো!
-’আপনি স্বীকার করতে চান না কেন?’ তুর্যয়ের ঠোঁটে দুষ্টু দামাল হাসিখানা ফিরে এসেছে।
-‘কী স্বীকার করব? কোনও অপরাধ করেছি নাকি?’ মেহেরু তুর্যয়ের হাসিটা প্রত্যক্ষ করছিল। রাজ্যের যুবরাজকে কেন এতো কিউট হতে হবে? এসবের কোনও মানে হয়?
-’আপনি আমাকে পছন্দ করেন এটা স্বীকার করে নিলেই তো পারেন! এতো লুকোচুরি কেন?'
মেহেরু চকিতে চোখ সরিয়ে নেয় অন্যদিকে, বুকে কেমন একটা কাঁপন ধরে। কথা বলতে গিয়ে কণ্ঠস্বরটাও হালকা কেঁপে যায়, ‘‘আপনার ধারণা ভুল। আমি মোটেও আপনাকে পছন্দ টছন্দ করি না। আপনি এক সময় আমার স্টুডেন্ট ছিলেন। এটা ভুলে যাবেন না।’
তুর্যয় কিছু একটা বলতে যাচ্ছিল। তার আগেই সেলফোনটা ঝনঝন করে বেজে উঠল। রানিমার নম্বর থেকে কল আসছে। তুর্যয় সরু চোখে একবার ফোনটা দেখে জরুরি গলায় বলল, ‘আমার আজকের অ্যাপয়েন্টমেন্ট গুলো একটু চেক করুন। সময়মতো রিমাইন্ডার দেবেন। বাইরে যারা অপেক্ষা করছেন তাদের ভেতরে আসতে বলুন।’
মেহেরু বসা থেকে উঠে দাঁড়িয়ে কুর্নিশ করে বলল, ‘মাচ অব্লাইজড। ইওর ম্যাজেস্টি!’
সেলফোনে হেঁশেলখানার ম্যানেজার ফোন করল ঠিক সেই সময়।
-’আপা, একটু কথা ছিল।’
-’জি বলুন।’
-’বাংলাদেশের একজন শেফ জয়েন করেছিল গত পরশুদিন। মনে আছে? আপনিই অফিসে নিয়ে এসেছিলেন।’
-’হ্যাঁ মনে আছে। কেন কী হয়েছে?’
-’উনাকে পাওয়া যাচ্ছে না।’
বুক কেঁপে উঠল।
-’পাওয়া যাচ্ছে না মানে?’
-’মানে গতকাল দুপুর থেকে তিনি নিখোঁজ।’
-’বলছেন কী!’
-’ঠিকই বলছি।’
-’পুলিশে রিপোর্ট করেছেন?’
-’এখনও করিনি। করার আগে মনে হল আপনি হয়তো মেয়েটির হদিশ জানলেও জানতে পারেন।’
-’আমি জানি না কিছুই ভাই! আপনি দ্রুত খোঁজ লাগান!'
--------------------------------------------------------------------
উর্মিলা রাজভবন সংলগ্ন দেহলিতে এসে দাঁড়িয়েছেন। সম্মুখের সুবিশাল চত্বরে শামিয়ানা টাঙ্গিয়ে ব্রাহ্মণ ভোজনের ব্যবস্থা করা হয়েছে। রান্না চড়ানো হয়েছে বিশাল বড় বড় হাঁড়িতে। আজ সবাই পেট পুরে খাবে। যত ইচ্ছে তত। প্রাসাদ তোরণের বাইরে পিলপিল করে ছেলে মেয়ে নির্বিশেষে নানা বয়সী মানুষ ভিড় জমিয়েছে। শামিয়ানার একপাশে ব্রাহ্মণরা বসবেন অন্যপাশে সাধারণ প্রজাগণ। সমুদ্রকুঞ্জ একটি ধর্ম নিরপেক্ষ রাজ্য। পূর্বে এরা কেতাদুরস্ত হিন্দু ছিল, কিন্তু বিগত কয়েক পুরুষ ধরে ধর্ম চর্চার পাট চুকে গেছে। রাষ্ট্রীয় ভাবে কোনও ধর্মীয় অনুষ্ঠান উদযাপন করা হয় না। তবে ব্যক্তিগত ভাবে ধর্ম পালনে কোনও বাধা নেই। রাজ্যে হিন্দু, মুসলিম, বৌদ্ধ, খ্রিস্টান, এমন কি মরমন, ইহুদীও আছে। উর্মিলার পাশে নীহারিকা আর বিজয় দাঁড়িয়ে আছে। রানি এবং রাজকন্যা, দুজনের পরনেই মসলিন কাপড়ের তৈরি লম্বা কুর্তা। দিল্লীর এক ফ্যাশন ডিজাইনার এই জামার ডিজাইন করেছে। ফ্যাশন ডিজাইনারের নাম ডাক আকাশচুম্বী। রাজভবনের সামনে একটি ঘোড়া সমেত ফিটন গাড়ি অপেক্ষা করছে। নীহারিকা এবং বিজয় এই গাড়িতে করে ভাই-রাজাদের মহল সফর করবে। উর্মিলার নিজেরও একবার অজয়কে দেখতে যাবার ইচ্ছে ছিল। কিন্তু আজকের ব্রাহ্মণ ভোজে তিনি উপস্থিত থাকতে চান। এ সময় স্বয়ং মহারাজার দর্শন দেবার নিয়ম নেই। রানিমাও আগে কখনও সশরীরে এই আয়োজনে যোগদান করেননি। আজকে তাঁর মনটা ভয়াবহ রকমের খারাপ। তাই মানসিক প্রশান্তি অন্বেষণের নিমিত্তে ব্রাহ্মণ সেবায় নিজেকে নিয়োজিত করতে চাইছেন। গণক মশাইয়ের ভবিষ্যৎ বাণী যদি সত্য হয় তবে শুধু রাজ্যেই নয় বরং তাঁর ব্যক্তিগত জীবনেও ভয়ঙ্কর প্রলয় সমাসন্ন। গণকের ভাষ্যমতে রাজ্যে এখনও জাদুকরদের কেউ কেউ ছড়িয়ে ছিটিয়ে বেঁচে বর্তে আছে। লুকিয়ে আছে। কিংবা হয়তো প্রকাশ্য দিবালোকে নিজ পরিচয় গোপন করে ঘুরে বেড়াচ্ছে। অথচ জাদুকরদের সমুদ্রকুঞ্জ থেকে বিতাড়িত করা হয়েছে আজ থেকে প্রায় আটাশ বছর আগে। এদের কেউ কেউ বিশ্বাসঘাতকতার অপরাধে এখন অবধি সাজা ভোগ করছে। তাহলে কি তাদের বাঁচিয়ে না রেখে মেরে ফেলাই উত্তম ছিল? অজয়ের অসুস্থতার ব্যাপারে আজ জানা গেলো এক ভয়াবহ তথ্য। গণকের মতে রাজবংশের ওপর পতিত অভিশাপই এই অস্বাভাবিক রোগের কারণ। কথাটা শোনার পর থেকে উর্মিলা অশ্রুজল সংবরণ করতে পারছেন না। তার সন্তানরা তো কোনও দোষ করেনি। পূর্বসুরিদের কর্মফল নির্দোষ ছেলেমেয়েগুলো কেন ভোগ করবে? গণকের ভবিষ্যৎ বাণী যদি সঠিক হয় তবে অজয় অল্প কিছুদিনের মধ্যেই মানুষ থেকে পিশাচে পরিণত হবে এবং ধীরে ধীরে এগিয়ে যাবে মৃত্যুর দিকে। এই বীভৎস অভিশাপ থেকে মুক্তির উপায় অজ্ঞাত। মহারাজের সাথে বিষয়টা নিয়ে আলাপ করতেই হলো শেষমেশ। এবারে মহারাজ তিব্বতে বসবাসকারী জাদুবিদ্যায় পারদর্শি এক সাধককে আমন্ত্রণ জানিয়েছেন। অল্প কয়েকদিনের মধ্যেই সেই সাধক রাজ্যে উপস্থিত হবে বলে আশা করা যায়। উর্মিলা অন্যমনস্ক হয়ে পড়ছিলেন। নীহারিকা এবং বিজয় ঘোড়ার গাড়িতে উঠে পড়েছে। উর্মিলার পাশে দাসি বাঁদিদের একটি বড় দল দণ্ডায়মান। তাদের হাত বোঝাই হয়ে আছে ত্রাণের দ্রব্য সামগ্রীতে। এর মাঝেই প্রজারা সারি বেঁধে দেহলি পাড় হয়ে চত্বরে প্রবেশ করেছে। দেহলি পাড় হবার সময় রানিমার সামনে দাঁড়িয়ে কুর্নিশ করছে। রানিমা প্রত্যেকের হাতে একটি নতুন কাপড় এবং দুইটি স্বর্ণ মুদ্রা তুলে দিচ্ছেন। শঙ্খবালা রানির পাশেই দাঁড়িয়ে ছিল। অনেকটা ফিসফিস করে চতুর গলায় বলল, ‘ রানিমা, মাস্টারের মেয়ে তো এখনও এলো না। সে আছে কোথায়?’
উর্মিলার মনে পড়ল মেহেরুর ঠিক বেলা বারোটায় এখানে উপস্থিত হবার কথা ছিল। অথচ ঘড়ির কাঁটা বারোটার ঘর অতিক্রম করেছে বহু আগে। মেহেরুর দেখা নেই। বিক্ষিপ্ত মনটা যেন আরও বেশি রকমের পীড়িত হয়ে উঠল। তুর্যয়ের কি এই মেয়েটির প্রতি বিশেষ কোনও দুর্বলতা আছে? বিদেশ যাবার আগেও পড়ার নাম করে ঘণ্টার পর ঘন্টা মেয়েটির সাথে সময় কাটাতো। তখন ছেলের বয়স কম ছিল। ব্যাপারটা দৃষ্টিকটু লাগলেও তিনি আমলে নেননি। কিন্তু এখন তুর্যয় রাজ্যের গুরুত্বপূর্ণ পদে আসীন হয়েছে। আজ বাদে কাল সমুদ্রকুঞ্জের এক এবং একচ্ছত্র অধিপতি হবে সে। এখন তাকে প্রতিটি পদক্ষেপ ফেলতে হবে হিসেব করে।ছেলেমানুষি করলে চলবে না। তাছাড়া এতো সুন্দরী মেয়ে অন্দরমহলের বাইরে নিয়মিত কাজ করা বিপজ্জনক। মেয়েটি এমনি ভদ্র এবং সুশীল। কিন্তু গরিব ঘরের সন্তান বলে কথা। লোভে পড়ে চরিত্র বিসর্জন দিতে কতক্ষণ? লোভ বড়ই খারাপ জিনিস। তিনি ঠিক করলেন তুর্যয়ের সাথে বিষয়টি নিয়ে সরাসরি কথা বলবেন। এসব ভাবতে ভাবতেই হঠাৎ অন্যরকম একটি চিন্তা তাঁর মাথায় এসে ডঙ্কা বাজাল। তিনি ঠিক করলেন মেহেরুর একটা বিয়ের ব্যবস্থা করবেন অতি দ্রুত। বিয়ের বয়স তো বহু আগেই হয়েছে। এই অনর্থক বিলম্ব কি একটু রহস্যজনক নয়? মেয়েটির অন্য কোনো মতলব নেইতো?
--------------------------------
ঘোষণা
এই লেখা কেউ কপি করবেন না। যদি আমার অনুমতি ব্যতীত আমার লেখা কোথাও পোস্ট করা হয় তবে আইনগত ব্যবস্থা নেয়া হবে। কপি কারীকে আমার লইয়ার সরাসরি লিগ্যাল নোটিশ পাঠাবে।
No comments