গল্প | উড়ান মেঘের দেশে - পর্ব-১৪ | Oran megher deshe - Part-14

লেখিকা-ওয়াসিকা নুযহাত 



কয়েকটা ক্ষণ হিমশীতল নিস্তব্ধতায় ভারী হয়ে রইল পাতালপুরীর বদ্ধ প্রকোষ্ঠের থমকানো বাতাস। অজয় লোকটার গলার ওপর চেপে বসে থাকা হাতটা খুব ধীরেধীরে সরিয়ে নিয়ে এলো।

সরাতেই প্রাণহীন জড়বৎ দেহখানা লুটিয়ে পড়ল মাটিতে। রাশিকার কণ্ঠ থেকে একটা ভয় মিশ্রিত গড়গড় শব্দ বেরোচ্ছিল। দু হাতের দশ আঙ্গুল দিয়ে সে নিজের মুখ চেপে ধরে আছে, তবুও কণ্ঠনালী নিঃসৃত অদ্ভুত আওয়াজটা ঠেকানো যাচ্ছে না। এক নিশ্ছিদ্র শঙ্কায় মৃগী রোগীর মতো থরথরিয়ে কাঁপছে সর্বাঙ্গ। অজয় ওর দিকে ঘুরে তাকালো। রক্তাক্ত চক্ষু, ঘর্মাক্ত কপাল, ক্রুর দৃষ্টি এবং বঙ্কিম খাঁড়া নাকের ভাঁজে নিষ্ঠুরতার নিবিড় খেলাধূলা! রাশিকার আত্মাটা এতক্ষণ কোন রকমে গলার কাছে আটকে ছিল, এবার ওই ভয়ঙ্কর চেহারা দেখে মনে হলো যেন যমদূত একেবারে সম্মুখে মূর্তিমান! 


কিন্তু রাশিকা জানে না যে এই মুহূর্তে চোখের সামনে যে ভয়ঙ্কর দর্শন দোপেয়ে প্রাণীটিকে দেখতে পাচ্ছে, সেই প্রাণীর আত্মায়ও বাঁধছেড়া প্রকট ভীতির সঞ্চার হচ্ছে, তোলপাড় হচ্ছে ...রক্তের প্রতিটি কণায় কণায় বয়ে চলেছে পশুত্ব এবং মনুষ্যত্বের অদম্য বীতশ্রদ্ধ লড়াই! লোকটাকে তো অজয় মেরে ফেলতে চায়নি। শাসাতে চেয়েছিল। আচমকা ভেতর থেকে এক আপাদমস্তক খুনি বেরিয়ে আসবে তা কে জানত? 


রাশিকা আগপিছ কিছু চিন্তা না করেই হুট করে দিল দৌড়। খোলা দরজা দিয়ে ঝড়ের বেগে বেরিয়ে এলো। আতঙ্কে তার হাতে পায়ে খিল ধরে গিয়েছিল। তবে যমের সামনে দাঁড়িয়ে প্রাণ বাঁচানোর তাগিদে মানুষ কী না করে! তার মনে হচ্ছিল আর কিছুক্ষণ ওই ভয়ঙ্কর করাল চেহারার দৈত্যর সামনে দাঁড়িয়ে থাকলে প্রাণ পাখি আর অক্ষত থাকবে না। তাই বাছ বিচার না করেই পলায়ন করল। মিনিট না গড়াতেই অন্ধকার সুড়ঙ্গের সিড়িঘরে ওকে পাকড়াও করল অজয়। রাশিকার গলা থেকে বেরিয়ে এলো মর্ম বিদারক করুণ আর্তনাদ। অজয় শক্ত করে চেপে ধরল ওর মুখ। টেনে হিঁচড়ে নিয়ে এলো নিচে। এক ধাক্কায় মেঝেতে ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে গর্জে উঠে বলল, ‘চুপ! একদম চুপ! নইলে জানে মেরে ফেলব!’ 


ত্রাসিত, শঙ্কিত এবং মুর্ছিত প্রায় রাশিকা এবার কান্নায় ভেঙে পড়ল। কাঁদতে কাঁদতে হেঁচকি ওঠার উপক্রম। 


-‘কোথায় পালাচ্ছিলে?’  


রাশিকা কান্নার জন্য কথা বলতে পারল না। অজয় কখনওই কোনও মেয়েকে চোখের সামনে এভাবে কাঁদতে দেখেনি। তার অসংখ্য মেয়ে বন্ধু আছে। প্রকৃত বন্ধু নয়, বলা যায় সকলেই সুখের মাছি। একসাথে থাকলেই আনন্দে মেতে ওঠা হয়, বিপরীত শরীরের সংস্পর্শে এলে যা অবশ্যম্ভাবী, তাইই হয়। কিন্তু মান অভিমান বা কষ্টের আদান প্রদান কখনওই হয় না! অজয় অসহিষ্ণু কণ্ঠে চেঁচিয়ে উঠল, ‘কান্না থামাও! নইলে ওই লোকটার মতো তোমার ঘাড়ও মটকে দেব।’ 


এই হুমকি শুনে রাশিকার কান্নার তোড় আরও বেড়ে গেলো। মেঝেতে হাত পা ছড়িয়ে অসহায় অবোধ শিশুর মতো বিলাপ করতে লাগল সে। এদিকে অজয়ের মাথাটা দুশ্চিন্তায় ওলট পালট হয়ে যাচ্ছিল। লাশটাকে নিয়ে কী করবে এখন? খবর ছড়িয়ে পড়লে তার প্রতি যতটুকু আস্থা সন্ধ্যার শেষ আলোর মতো লেপটে আছে বাবা মায়ের বুকের ভেতর সেই আলোটুকুও মুছে যাবে। রাজ্যের রাজকুমার বলে হয়তো তার যথোপযুক্ত শাস্তি হবে না। আইনের ফাঁকফোকর গলিয়ে যে করেই হোক মুক্তি পাবে। কিন্তু এই কলঙ্ক লোকমুখে ঘুরে বেড়াবে বহুদিন পর্যন্ত। পরিবারের প্রতিটি মানুষের চোখে সে ছোট হয়ে যাবে। 


একটা মানুষের লাশ গুম করে ফেলা কি চরম ধরণের অপরাধ নয়? এই অপরাধের ভার নিয়ে বাকি জীবনটা সুস্থ ভাবে কাটাবে কী করে সে? হায় ঈশ্বর! কী থেকে কী হয়ে গেলো! মানুষের মৃতদেহ সামনে নিয়ে বসে আছে। সাথে একটা অবুঝ শিশুর মতো বেকুব মেয়েমানুষ। এখন উপায় কী হবে? কী করবে অজয়? রাগে, ক্ষোভে এবং অসহায়ত্বে পাগলের মতো লাগছে তার। মাথার ভেতর শোঁশোঁ করে একটা উদ্দাম ঝড় বয়ে যাচ্ছে। প্রচণ্ড ক্রোধ নিয়ে দেয়ালের গায়ে একটা ঘুষি বসিয়ে দিল। কেঁপে উঠল পুরো পাতালপুরী। রাশিকার কান্না একটা হেঁচকিতে এসে থমকে দাঁড়ালো। ভয়ার্ত দুটি মার্বেলের মতো বড়বড় চোখ নিয়ে সে দেখতে পেলো সামনে দাঁড়ানো ভয়ঙ্কর মানুষটা ক্রমাগত দেয়ালে মাথা ঠুকে যাচ্ছে পাগলের মতো। মুখ দিয়ে একটা গোঙ্গানির শব্দ বেরোচ্ছে। রাশিকা স্তব্ধ হয়ে চেয়ে রইল কিছুক্ষণ। তার হৃৎপিণ্ডের স্পন্দন থেমে গেছে। থেমে গেছে ধমনীর রক্ত প্রবাহ। সামনের মানুষটা কি পাগল হয়ে গেছে? দেয়ালে এমন ভাবে মাথা ঠুকছে যে আর কিছুক্ষণ এই প্রক্রিয়া চললে নির্ঘাত মাথার খুলি খসে পড়বে। কী মুশকিলে পড়া গেলো! কাঁপতে কাঁপতে উঠে দাঁড়ালো রাশিকা। অজয়ের কাছাকাছি যেতে তার ভয় হচ্ছে। দূর থেকেই কম্পিত গলায় বলল, ‘এরকম করছ কেন?’ 


অজয় ওর কথা শুনল না। ক্রমাগত দেয়ালে মাথা ঠুকতে লাগল। রাশিকা এখন বুঝতে পারল ছেলেটা নিজেকেই নিজে গালাগাল দিচ্ছে। ইংরেজি একটা গালি বারবার আওড়াচ্ছে, দাঁতে দাঁত চিবিয়ে। রাশিকা জান হাতে নিয়ে কয়েক পা এগিয়ে গেলো, একটা কম্পনরত হাত অজয়ের শক্ত বাহুর ওপর খুব সাবধানে রেখে বলল, ‘শোনো ভাই রাজকুমার! একটু শোনো প্লিজ!’ অজয় মাথা ঠোকরানো বন্ধ করে ঘটাং করে ঘাড় ঘুরালো রাশিকার দিকে। ওর কপাল থেকে রক্তের একটা ধারা বয়ে এসে নাক ছুঁয়েছে। রাশিকা আঁতকে ওঠা গলায় বলল, ‘তুমি কি পাগল?’ 


অজয় এলোমেলো শ্বাস ফেলতে ফেলতে অপ্রকৃতস্থের গলায় বলল, ‘আই জাস্ট কিলড আ ম্যান। হোয়াট এলস ডু ইউ এক্সপেক্ট ফ্রম মি?’ 


রাশিকা সম্মুখের রক্তাক্ত মুখটার দিকে এতক্ষণে নিবিড় চোখে চাইল। আর চাওয়া মাত্রই বুঝতে পারল যে প্রাণীর ভয়ে সে বিগত বেশ খানিকটা সময় জবুথবু হয়ে কান্নাকাটি করেছে সেই প্রাণীর নিজ চোখেই এখন জবজব করছে ভয়ঙ্কর অসহায়ত্ব। সঙ্গে সঙ্গে চেতনা ফিরে এলো যেন। এই ছেলেটা যদি সঠিক সময়ে উপস্থিত না হত তাহলে ওই কামার্ত মধবয়স্ক ধর্ষক লোকটা এতক্ষণে তার সর্বনাশ করে ছাড়ত। হয়তো মেরেই ফেলত। ছেলেটা ওই লোককে খুন করে আদতে তার প্রাণ রক্ষা করেছে। 


-’মেরে ফেলতে গেলে কেন?’ 


-’আমি তো বুঝিনি ব্যাটা এত তাড়াতাড়ি পটল তুলবে।’ 


এটুকু বলে একটু বিরতি নিল অজয়। তারপর রাশিকার মুখের দিকে চেয়ে অসহায় গলায় প্রশ্ন করল, ‘এখন কী করব?’ প্রশ্নটা এমন ভাবে করল যেন রাশিকা তার অনেকদিনের চেনা বন্ধু। রাশিকা চোখের জল মুছে নিয়ে একটা বড় শ্বাস টেনে নিল। আজকের দিনটা যেন তাকে পুরো দস্তুর অন্য মানুষ করে তোলার শ্বপথ নিয়েছে। সারাক্ষণ হাসতে থাকা, খেলতে থাকা, ফড়িং এর মতো নাচতে থাকা মেয়েটাকে আজকের এই দিন এমনই এক বীভৎস সংকটের সামনে এনে দাঁড় করিয়েছে যে মেয়েটার এখন নিজের অস্তিত্ব ভুলে যাবার দশা হয়েছে। সে অধৈর্য গলায় বলল, 


-’তুমি যদি সত্যিকারের রাজপুত্র হও, তাহলে তোমার ভয় কীসের? তোমার তো শাস্তি হবে না!’ 


-’খবরটা ছড়িয়ে পড়লে শাস্তি না হলেও ট্রায়াল হবে। এখন মিডিয়া অনেক বেশি তৎপর। আজেবাজে লেখালেখি করবে। এই লোকের পরিবারের লোকজন বিচার চাই বিচার চাই বলে নির্ঘাত একটা হাঙ্গামা বাঁধাবে।’ 


এতো জটিল ভাবে চিন্তা করেনি রাশিকা। কথাগুলো শুনতে পেয়ে তার দুশ্চিন্তার মাত্রা বেড়ে গেলো। ঠোঁটজোড়া শুকনো খড়খড়ে। গলায় এক সমুদ্র তৃষ্ণা। মনে হয় যেন কতকাল জিবে জল ছোঁয়ানো হয়নি। শুকনো খড়খড়ে ঠোঁটদুটোকে কোনও ক্রমে নেড়ে বলল, ‘তাহলে কাউকে না জানালেই তো হলো। আর যদি জেনেও যায়, আমি বলব তুমি আমাকে বাঁচাতে চেয়েছিলে, লোকটাকে মারতে চাওনি।’ 


অজয় অবিশ্বাসের গলায় বলল, ‘তুমি এটা বলবে?’ 


-’নিশ্চয়ই বলব! সত্য বলতে বাঁধা কোথায়?’ 


-’তুমি যে সত্য বলছ এটার প্রমাণ কী? লোকে কেন বিশ্বাস করবে?’ 


-’কেন বিশ্বাস করবে না? তুমি আমার কে? আমি কেন তোমাকে বাঁচাবার জন্য মিথ্যা বলব?’ 


অজয় চিন্তিত ভাবে ঘাড় নাড়ে, ‘তাও ঠিক। তবুও আমাদের প্রমাণ দরকার। ‘ একটু চুপ থেকে সে আবারও বলল, ‘আইডিয়া! আমাদের মেডিকেল রিপোর্ট দরকার। যেখানে প্রমাণ থাকবে তোমাকে রেপ করা হয়েছিল।’ 


রাশিকার মুখ ঝুলে গেলো, ‘বলছ কী? রেপ তো হয়নি।’ 


-’অ্যাটেম্পট তো হয়েছিল! ফলস রিপোর্টও তৈরি করা যায় চাইলে।’ 


-’তুমি বুঝতে পারছ না। মেডিকেল রিপোর্ট পাব্লিশ হলে ঘটনাটা জানাজানি হয়ে যাবে। রেপ হয়নি তবুও লোকে আমাকে ধর্ষিতা বলবে। আমার বাবা জানতে পারলে ... ‘ রাশিকা কান্নার চাপে আর কথা বলতে পারল না। কণ্ঠরোধ হয়ে এলো। 


অজয় প্রসঙ্গ পাল্টে নিল, ‘বুঝতে পেরেছি। কিন্তু লাশটা নিয়ে কী করব?’ 


রাশিকার আত্মা কাঁপছে ভয়ে। মৃতর চোখদুটো খোলা। জিবটা বেরিয়ে আছে। লোকটা একটু আগে পশুর মতো ঝাঁপিয়ে পড়েছিল তার গায়ে। কী ভয়ঙ্কর কষ্ট যে হচ্ছিল সেই সময়, যখন দুটি শক্তপোক্ত তাগড়া পুরুষ বলির পাঁঠার মতো হাত পা বেঁধে তাকে বলাৎকারের চেষ্টায় রত হয়েছিল। এই ছেলেটা সময়মতো না আসলে কী হত চিন্তা করেই গা শিউরে উঠছে। তথাপি সামনে পড়ে থাকা মৃত লাশটাকে দেখে তার আনন্দ হচ্ছে না। বরং ভয় হচ্ছে। নিজের মৃত্যুর অমোঘতার কথা মনে পড়ছে। একদিন তো তাকেও মরতে হবে। মৃত্যু কি এতই সোজা? এতই তড়িৎ গতিসম্পন্ন? কেমন লাগে মানুষের মৃত্যুর সময়? মৃত্যুর পর মৃত ব্যক্তিরা কোথায় যায়?  


অজয় আর এক সেকেন্ডও নষ্ট না করে লাশের বাহু ধরে ওপরের দিকে টেনে তুলল। মৃতদেহ লম্বা চওড়া। ভালোই ওজন। রাশিকাকে কিছু বলতে হলো না সে নিজ থেকে এগিয়ে এসে হাত লাগালো। এতো ভারী! রাশিকার মনে হচ্ছিল আরেকটু হলেই প্রাণ বেরিয়ে যাবে। সুড়ঙ্গর চাপা সিঁড়ি দিয়ে মরা লাশ টেনে তুলতে দুজনকে বেশ কসরত করতে হল। রাশিকা বলছিল, ‘কেউ দেখে ফেললে কী হবে?’ 


-’রাত হয়ে গেছে। এদিকটায় কারো থাকার কথা না এই সময়।’ মুখে বলল অজয়। কিন্তু সে জানে গুণ্ডা বাহিনির গুণ্ডারা যেকোনো মুহূর্তে পাতাল ঘরে হানা দিতে পারে। তাই যা করার অতি দ্রুত করতে হবে। হঠাৎ মনে পড়ল এই লোকের সাথে আরেকটা ছোকরা ছিল। সে নিশ্চয়ই দুদিন পর সঙ্গীর খোঁজ করতে আসবে। অতএব ঘটনাটা অত সহজে ধামাচাপা দেয়া সম্ভব হবে না। ওপরের পৃথিবীতে তখন নিশুতি রাত। ঝিঁঝিঁ ডাকছে। বাগানের ওপর জড়ো হয়ে আছে সাদা পেখমের পলকা মেঘ। চারপাশ এতো বেশি নিস্তব্ধ যে নিজের হৃৎপিণ্ডের ওঠানামার শব্দটুকুকে মনে হচ্ছে যেন যুদ্ধের দামামা। মহলের কাছাকাছি প্রহরীরা পাহারারত অবস্থায় আছে। তাই ওদিকটায় যাওয়া যাবে না। সুড়ঙ্গ মুখের পাশের মাটিতে লাশটাকে রাখল ওরা। এদিকে ঘুটঘুটে অন্ধকার। অন্ধকারে ভেসে বেড়ানো সাদা মেঘের গায়ে সবুজ আলো জ্বেলে কয়েকটা জোনাকি উড়ছে। পাশেই বাগানের উঁচু পাঁচিল। অজয় জানে এদিকের পাঁচিলে একটা ফোঁকর আছে। অনেক পুরনো ফোঁকর। কী কারণে যেন মেরামত করা হয়নি। ভাঙা দেয়ালটার ওপাশেই মহুয়ার জঙ্গল। অজয় খুব চাপাস্বরে বলল, ‘এসো আমার সাথে। ধরো এটাকে।’  


রাশিকা হুকুম মোতাবেক কাজ করল। ভাঙা পাঁচিল ডিঙ্গিয়ে জঙ্গলে পৌঁছুতে পাক্কা পাঁচ মিনিট সময় লাগল। পায়ের তলায় শুকনো পাতা আর গাছের ডাল মড়মড় করছিল। নিজেদের পায়ের ধ্বনি ওদের বুকের মধ্যে চমকানো শিহর তুলে যাচ্ছিল। মেরুদণ্ডে একটা গা ছমছমে ঠাণ্ডা স্রোত! উঁচুনিচু ঢালু পথ পেরিয়ে পাহাড়ের শেষ প্রান্তের দিকে এগোচ্ছিল অজয়। গাছের পাতায় পাতায় বাতাস নানারকম রহস্যময় শব্দর সৃষ্টি করছে। অনবরত ডেকে যাচ্ছে ঝিঁঝিঁ পোকা আর নাম না জানা বিভিন্ন প্রজাতির রাতচরা পাখিরা। রাশিকা ফিসফিস করে বলল, ‘কোনদিকে যাচ্ছ? কী করবে?’


অজয় নিজেও জানে না কী করবে। বিভ্রান্ত গলায় বলল, ‘কবর দিব? নাকি পাহাড় থেকে ফেলে দেব?' 


-’আমার মনে হয় এখানেই রেখে যাও।’ 


-’কিন্তু লাশ খুঁজে পাবার পরে তো তদন্ত হবে।’ 


-’তুমি তোমার বাবাকে বলে তদন্ত বাতিল করতে পারবে না?’ 


অজয় মাথা নাড়ে -’আমি কিছুতেই বাবার হেল্প নিব না। তার চোখে ছোট হতে পারব না।’ 


কোনও রাজপুত্র যে কখনও মধ্যবিত্ত ঘরের সাধারণ ব্যক্তিত্বের ছেলেদের মতো কথা বলতে পারে রাশিকা তা স্বপ্নেও ভাবেনি! তার সন্দেহ হল অজয় বোধহয় সত্যিকারের রাজপুত্র নয়। সে সন্দিহান কণ্ঠে বলল, ‘তুমি কি আসলেই রাজপুত্র?’ 


অজয়ের মেজাজ চড়ে যায়। তার রাগ আজকাল নিয়ন্ত্রণে রাখা বড়ই দায়। হুটহাট ভেতরকার পশু সত্ত্বা জাগ্রত হয়ে ওঠে। রাগটা অনেক কষ্টে দমন করে বলল, ‘এটা কি এসব ফালতু কথা বলার সময়?’ 


-’না।’


-’তাহলে বলছ কেন?’ 


-কী জানি! 


-’তুমি এখানে দাঁড়াও। আমি দেখি কোথাও মাটি খোঁড়ার কোদাল পাওয়া যায় কিনা।’ 


-’অসম্ভব! আমি একটা জ্যান্ত লাশের সাথে একলা দাঁড়িয়ে থাকতে পারব না।’ 


-’লাশ কখনও জ্যান্ত হয় না।’ 


-‘জানি ... কিন্তু আমার কেন যেন মনে হচ্ছে এই লাশ আমার দিকে বড়বড় চোখে তাকিয়ে আছে। তুমি চলে গেলেই খ্যাচ করে একদম কল্লা নামিয়ে দেবে।’ 


অজয় চাপা গর্জনের সাথে বলল, ‘তোমার মতো ব্যাক্কল মেয়েমানুষ আমি আমার জীবনে দেখিনি!’ 


রাশিকা ফোঁস করে উঠল একদম , ‘আমি ব্যাক্কল? আর তুমি কী? তুমি তো রাক্ষসকুমার! নিজের চেহারা দেখেছ কখনো আয়নায়?' কথাটা বলে এক সেকেন্ডের জন্য থামল সে। তারপর কাঁদো কাঁদো গলায় বলল, ‘এসেছিলাম প্রিন্স চার্মিং এর সাথে দেখা করতে, তার বদলে মাঝ রাতে পাশে পেলাম প্রিন্স মন্সটারকে, সাথে জলজ্ব্যান্ত এক লাশ ফ্রি! পোড়া কপাল!’    


-’কী বিরক্তিকর! তোমাকে বাঁচাতে যাওয়াটাই আমার ভুল হয়েছে আসলে।’ 


-’তুমি তো আমাকে বন্দি করার আদেশ দিয়েছিলে। আমার হাত পা বেঁধে কবরের মতো অন্ধকার ঘরে …’ হঠাৎ কাছাকাছি কোথাও গাছের ডাল ভাঙার শব্দ হলো। কেউ একজন ভারী পা ফেলে কাছে এগিয়ে আসছে। অন্ধকার রাতের গায়ে আচমকা ঝলসে উঠল নীল রঙের দুটো জ্বলন্ত চোখ। ওদের নিশ্বাস থমকে গেছে। রাশিকার মুখ থেকে অনায়াসে বেরিয়ে এসেছে এক অত্যুৎকট আর্ত চিৎকার। 


অজয় লাশ ফেলে রেখে মুহূর্তের মধ্যে রাশিকার কবজি খামচে ধরল। তারপর শুরু করল দৌড়। কী আশ্চর্য! ওর শরীর এখন পাখির মতো হালকা। চাইলেই যেন উড়ে যেতে পারবে। রাশিকা পায়ের জোরে ওর সাথে পেরে উঠছে না। অজয় রাশিকার কোমর জড়িয়ে ধরে প্রায় শূন্যে তুলে ফেলেছে। পেছনে নীল জ্বলন্ত চোখের জন্তুটা তীরের বেগে ছুটে আসছে। অজয়ও কোনও অংশে যেন চারপেয়ে জন্তুর চেয়ে কম নয়। বাতাসের চেয়েও ক্ষিপ্র এবং তীব্র তার গতি!   


----------------------- --------------------------------


দরবারের কক্ষটি লম্বাটে। কক্ষর একদম সম্মুখ ভাগে রয়েছে ময়ূর সিংহাসন। কোহিনূর হিরা, রুবি, পান্না এবং গার্নেট খচিত এই সিংহাসনটি তৈরি করেছিল আজ থেকে চারশত বছর আগে ইয়োরোপীয় এক স্থাপত্য শিল্পী, চড়া মূল্যের বিনিময়ে। এর ওজন দুইশ চুয়াত্তর কেজি। প্রতি বছর মেরামত করা হয় বলে এখনও ঝকঝকে, তকতকে। আগে মাথায় পাগড়ি এবং মুকুট পরে রাজার ওই সিংহাসনে বসার নিয়ম ছিল। পাশে দাঁড়িয়ে থাকত পাখা ওয়ালা। বিশাল ঝালর সমৃদ্ধ পাখা নেড়ে বাতাস দেয়া হত। দুপাশে সারি বেঁধে বসতেন উজির প্রজারা। বিশেষ ঐতিহ্যবাহী মুহূর্ত ব্যতীত সাধারণ দিনগুলিতে মহারাজ বীরবল ময়ূর সিংহাসনে আসন গ্রহণ করেন না। চেয়ার টেবিলে বসেন। কক্ষের দেয়ালে হংসমণি বংশে এই পর্যন্ত যতজন শাসক এসেছে তাদের প্রত্যেকের ছবি টাঙ্গানো আছে। চার কোণে চারটি বর্ম পোশাক ধারী বিশালাকারের মূর্তি। মাথার ওপরে গির্জার মতো গম্বুজ। গম্বুজের ছাদ থেকে ঝুলে আছে একাধিক ঝাড়বাতি। চারটি বড় বড় জানালা থাকার পরেও বিস্তৃত কক্ষটির অভ্যন্তরে কথা বললেই প্রতিধ্বনি হয়। যেন শত বছরের ঘুমন্ত ইতিহাস দেয়ালে দেয়ালে ধাক্কা খেয়ে জাগ্রত হয়ে ওঠে। লম্বা সেগুন কাঠের টেবিলের শেষ প্রান্তে রাজার চেয়ার। মহারাজের বাম পাশে তুর্যয় বসেছে এবং ডানপাশে উর্মিলা। উর্মিলার পার্শবর্তী চেয়ারে বসেছেন প্রধানমন্ত্রী। এছাড়া পুরো টেবিল জুড়ে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে রাজ্যের গণ্যমান্য ব্যক্তিগণ। অর্থনীতি, শিক্ষা, যোগাযোগ ও উন্নয়ন ইত্যাদি গুরুত্বপূর্ণ সরকারি খাতের প্রতিনিধি হয়ে এসেছে এরা। তুর্যয়ের পরনে একটা কালো কোট, সাদা শার্ট। গলায় টাই নেই। চুলগুলো জেল দিয়ে পাট করে আঁচড়ানো। গৌড়বর্ণের গালে কালো চাপদাড়ির পাতলা আস্তরণ। চোখে অস্থিরতা। মুখজোড়া অপ্রসন্নতার গহন ছায়া। অন্যমনস্ক ভাব বিরাজ করছে আচরণে। কাজে সে কখনওই অমনোযোগী ছিল না। লন্ডনে নামকরা বিশ্ববিদ্যালয়ের রিসার্চ অ্যাসিস্টেন্ট হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছে, নিজস্ব পড়াশোনার পাশাপাশি। কখনওই একনিষ্ঠতার নড়চড় হয়নি। আজ পর্যন্ত যেখানে হাত দিয়েছে, সেখানেই সোনা ফলেছে। সে আপাদমস্তক এক জ্যোতির্ময় পুরুষ। তার উপস্থিতিতে সর্বদাই যেন দ্যুতির বিকিরণ ঘটে। অন্ধকার দূরীভূত হয়। কিন্তু আজকে তার মুখে মেঘের ঘনঘটা। পুত্রের এই ব্যতিক্রম আচরণ লক্ষ্য করছিলেন মহারাজ। একবার তিনি নিচু স্বরে প্রশ্ন করলেন, ‘তুমি ঠিক আছ?’ পিতার প্রশ্ন তুর্যয়ের কর্ণগোচর হলো না। একটা পেপার ওয়েইট হাতে নিয়ে নাড়াচাড়া করছে সে এবং নিজস্ব চিন্তায় মগ্ন হয়ে আছে। মেহেরু চাকরির প্রস্তাব বিনা দ্বিধায় নাকচ করে দেবে এটা ছিল ভাবনার অতীত। সে মনে প্রাণে বিশ্বাস করে প্রতিটি মানুষের স্বাধীন ভাবে সিদ্ধান্ত নেয়ার অধিকার আছে । অপরের সিদ্ধান্তকে সম্মান দেখানোতে তার কোনও কার্পন্য নেই। কিন্তু আজকে তার সমস্ত মূল্যবোধ এবং নৈতিকতা এলোমেলো হয়ে উঠছে। একজন সামান্য বেতনভুক কর্মচারির এতো বড় স্পর্ধা হয় কী করে? মেহেরু কি জানে? তুর্যয় চাইলে সে এবং তার পরিবারকে এক রাতের মধ্যে দেশ থেকে বিতাড়িত করতে পারে? রাজ্যের বড় রাজকুমারের আদেশ অমান্য করার শাস্তি কীরুপ ভয়াবহ হতে পারে, সে সম্পর্কে কি তার বিন্দুমাত্র ধারণা আছে? ক্রোধের দাপাদাপিতে তুর্যয়ের শ্বাস প্রশ্বাস বিঘ্নিত হচ্ছিল। এই অপমান সে মেনে নেবে না কিছুতেই। পাঁচ বছর আগে প্রেম প্রত্যাখ্যান করে মেহেরু যে অপরাধটা করেছিল, সেই অপরাধ এখনও ক্ষমা করেনি সে। সেই প্রত্যাখ্যানের পর আর কোনদিনই মনের অলিগলি দিয়ে হাঁটা হয়নি। কেটেছে নারীসঙ্গ বর্জিত একাকী দিন। সেইসব বিহর্ষ একাকীত্বের হিসেব নিকেশ এবার মেহেরুকে চুকিয়ে দিতে হবে যে করেই হোক। তুর্যয়ের মস্তিষ্কে এখন কোনও যুক্তি খেলছিল না, রাগের ধোঁয়াটে প্রকোপে যুক্তিবোধ এবং নৈতিকতা ক্রমশ অদৃশ্য হয়ে উঠছে। 


আচ্ছা, মানুষের চেহারা দেখে কি কখনও ঠাওর করা যায় সে কেমন পরিবারের সন্তান কিংবা কী তার জন্ম পরিচয়? যাওয়ার কথা না, কিন্তু তুর্যয়কে দেখামাত্রই কী করে যেন বোঝা যায় যে এই যুবকের শরীরে নিশ্চিত ভাবে কোনও অভিজাত বংশের রক্ত বইছে। এরকম দেখতে একজন মানুষকে বুঝি রাজ পরিবারের সিংহাসনেই মানায়, কোনও সাধারণ মানুষীর হৃদয় সিংহাসনে নয়। ভাবছিল মেহেরু, দরবার সংলগ্ন ছাদওয়ালা বারান্দায় দাঁড়িয়ে, জানালায় চোরা চোখ স্থাপন করে। ঘড়ির কাঁটা দশটা ছাড়িয়ে গেছে বহু আগে। গণক মশাইকে তার গ্রামে রেখে আসতে হয়েছে। প্রাসাদে ফিরতে ফিরতে বেজে গেছে সাড়ে দশটা। অফিস ঘরটা তুর্যয়ের নিজস্ব মহলের নিচতলায়। সাড়ে দশটার সময় অফিসে উপস্থিত হয়ে মেহেরু দেখল তুর্যয় অনুপস্থিত। একজন ভৃত্যর কাছ থেকে জানা গেলো দরবার বসে গেছে। দরবারে সচরাচর অন্দর মহলের কর্মচারিরা যায় না। সরকারের গুরুত্বপূর্ণ পদে বহাল থাকা লোকজনের উপস্থিতিতে ভরপুর এই স্থান। মেহেরুর ভেতরে ঢোকার স্পর্ধা বা অনুমতি কোনটাই নেই। জানালার কিনার ঘেঁষে দাঁড়িয়ে রইল। নিয়োগপত্র গতকাল রাতেই তার কাছে ইমেইল করা হয়েছে। কিন্তু এ এক অদ্ভুত নিয়োগপত্র। মাসোহারার স্থানটি খালি। তুর্যয়ের দ্বারাই এসব অদ্ভুত কাজ সম্ভব। ওর সাথে বেতন নিয়ে বাকবিতণ্ডা করবে এমন কিছু ভাবতে গিয়েও সংকোচ হচ্ছে। কিন্তু নির্মম সত্য হল মাস শেষে একটা মোটামুটি অংকের অর্থ তার অতীব প্রয়োজন। এই অর্থের ওপর নির্ভর করেই তার পরিবার বেঁচে আছে। মনটা বড়ই অশান্ত। প্রতিটি রোমকূপে খেলছে চাপা দুশ্চিন্তার ঢেউ। প্রথম দিন দেরিতে উপস্থিত হওয়ায় রাজকুমার কি খুব বেশি রেগে যাবে? যে তুর্যয়কে সে বছর খানেক আগে চিনত সেই তুর্যয় তো নিঃসন্দেহে হারিয়ে গেছে, এখন ওই দরবারের মধ্যমণি হয়ে মহারাজার পাশে আসন গ্রহণ করা মুখচেনা যুবকটি তার ছাত্র নয়, বন্ধুও নয়, এই যুবক সমুদ্রকুঞ্জের সম্ভ্যাব্য যুবরাজ। ভাগ্য গুণে তার চাকরি হয়েছে যুবরাজের ব্যক্তিগত দপ্তরে। এই খবর যে শুনছে, সেইই চোখ কপালে তুলছে। চোখে ঝিলিক দিছে অবিশ্বাস, বিস্ময় এবং ঈর্ষা। গৃহ শিক্ষকদের সমাজের লোকেরা একটা নাম কা ওয়াস্ত সম্মান দেয় ঠিকই, কিন্তু গুরুত্ব দিতে চায় না খুব একটা। এতকাল মেহেরু শুধুই রাজবাড়ির গৃহশিক্ষক ছিল, রানিমার ফরমায়েশ খাটা দাসি ছিল। আজ থেকে সে খোদ যুবরাজের অফিস সেক্রেটারি। অন্দরমহলের মেয়েলি কাজে তার ডাক পড়বে কদাচিৎ। রানিমার খুব কাছের লোক হওয়া স্বত্বেও দাসি বাঁদিদের কট্টর দৃষ্টি তার পিছু ছাড়েনি কখনো। দাসিরা তাকে নিজেদের সমগোত্রীয় ভাবতে ভালোবাসত। একটু পুরনো যারা, এই যেমন শঙ্খবালার মতো কয়েকজন, এরা কটু কথা শোনাতেও পিছপা হতো না। এবারে তার কাজের ক্ষেত্র হবে সম্পূর্ণ ভিন্ন। অন্দরমহলের দাসিরা তার টিকিটাও খুঁজে পাবে না। লোকে হয়তো যেকোনো খবর যুবরাজের কান পর্যন্ত পৌঁছানোর জন্য তার কাছে তদবীর করতে আসবে। শুধু তুর্যয় ছাড়া তার আর কোনও ইন চার্জ থাকবে না। জবাবদিহি করার জায়গা থাকবে না। ভেবে দেখেছে অনেক, অন্দরমহলের মেয়েদের চক্ষুশূল হয়ে বেঁচে থাকার চাইতে তুর্যয়ের অফিস সেক্রেটারি হওয়া নিঃসন্দেহে উত্তম। এসব ভাবনা তার অন্তরে যেমন প্রচ্ছন্ন একটা প্রশান্তির উদ্রেক করছিল ঠিক তেমনি উদ্বেগ উত্তেজনাও কিছুমাত্র কম ছিল না। তুর্যয়ের মুখোমুখি দাঁড়াতেই যত ভয় এবং অস্বস্তি। ওই একরত্তি ছেলের ব্যক্তিত্ব গুরুতর এবং গম্ভীর! হঠাৎ মাথায় এলো ব্যাপারটা, নিয়োগপত্রে অফিস সেক্রেটারি নয় বরং পদবির নাম উল্লেখ করা হয়েছে 'পারসোনাল সেক্রেটারি।' দুটোর মধ্যে তফাৎ আছে নিশ্চয়ই! হঠাৎ কী মনে করে যেন তুর্যয় জানালার বাইরে তাকালো একবার। চোখে চোখ পড়ল। কিছুক্ষণের জন্য চারটি চোখের মাঝে একটি সেতু বন্ধন তৈরি হলো। পর মুহুর্তেই জানালা থেকে সরে দাঁড়ালো মেহেরু। তার বুকটা কিশোরী মেয়েদের মতো ঢিপঢিপ করে কাঁপছে। আবেগে? নাকি উত্তেজনা আর দুশ্চিন্তায়? কে জানে! 

 

মিনিট বিশেক সময় ওখানেই দাঁড়িয়ে রইল সে। দরবার ভাঙল বেলা সাড়ে এগারোটায়। সভাসদদের পদশব্দে গুঞ্জরিত হলো দরবার সংলগ্ন দেহলি। মেহেরু হাতে নিয়োগপত্রের ফাইল নিয়ে গুটিসুটি হয়ে দাঁড়িয়ে ছিল এক পাশে। কেউ কেউ তার দিকে আড়চোখে তাকাচ্ছে। তার রুপের চটকটাই এমন, যে কেউ না তাকিয়ে থাকতে পারে না। রানিমা বেরোবার সময় কুটিলবক্র চোখে একবার তাকালেন তার দিকে। স্বয়ং মহারাজ দরবার থেকে বেরোনোর মুখে থমকে দাঁড়ালেন। মেহেরু সঙ্গে সঙ্গে কুর্নিশ করল। মহারাজ কিছু বললেন না, মেহেরুর অবনত মস্তকটার দিকে চেয়ে কী যেন স্মরণ করার চেষ্টা করলেন। বুকটা ভয়ে আর শঙ্কায় দুলছিল মেহেরুর। জলমহলের ঘটনাটা মনে পড়ছিল। কী হবে মহারাজের যদি পুরো ঘটনাটা মনে পড়ে যায়? শুনতে পেয়েছে রানিমা নাকি গোয়েন্দা লাগিয়েছেন সেদিনের ঘটনার সত্যতা উদ্ধারের জন্য। 


তুর্যয়ের সাথে প্রধানমন্ত্রী জাফর বেরিয়ে এলেন। নিচু স্বরে কথা বলছিলেন তিনি। তুর্যয় চোখের কিনার দিয়ে একবার মেহেরুকে দেখল। তার চোখে কালো রোদ চশমা। কপালে ভাঁজ। তবে মুখে এখন আর ক্রোধের দাপট নেই। মেহেরু বড়ই বিচলিত বোধ করছে। তার কর্মজীবন কেটেছে অন্দরমহলের চার দেয়ালের মধ্যে। জীবনে প্রথমবারের মতো রাজ্যের এতো গুরুত্বপূর্ণ মুখ একসাথে দেখতে পেয়েছে সে। তুর্যয় প্রধানমন্ত্রীর সাথে কথা বলতে বলতে এগিয়ে যাচ্ছিল। মেহেরু কী করবে বুঝতে পারছে না। কয়েক সেকেন্ড থম ধরে দাঁড়িয়ে থেকে তুর্যয়কে অনুসরণ করে হাঁটতে লাগল। দরবার থেকে তুর্যয়ের মহল মাইল খানেক দূরে। সামনের খোলা চত্বরে একটি ঘোড়ার গাড়ি এবং লিমোজিন রাখা আছে। তুর্যয় ঘোড়ার গাড়িতে উঠল না। লিমোজিনের সামনে এসে থমকে দাঁড়ালো। তারপর ঘুরে তাকালো পেছনে। মেহেরু কয়েক হাত দূরে দাঁড়িয়ে আছে। তার পরনে একটি জাম রঙের শাড়ি। ঘাড়ের ওপর মস্ত খোঁপা। চকচকে মসৃণ মুখের ত্বকে দুশ্চিন্তা এবং অস্বস্তির সুতীব্র উপস্থিতি।


-’কিছু বলবেন?’ 


সরাসরি প্রশ্নটায় অপ্রস্তুত বোধ করে মেহেরু। কী বলবে বুঝে পায় না। কুর্নিশ করতেও ভুলে যায়। নাকাল চোখে চেয়ে রয়। কাছেই তুর্যয়ের দেহরক্ষী দণ্ডায়মান। আরও আছে লিমোজিনের ড্রাইভার। খানিক দূরে স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী দাঁড়িয়ে থেকে দৃশ্যটা অবলোকন করছেন। মেহেরু দ্বিধাগ্রস্ত গলায় আমতা আমতা করে বলল, ‘ইয়ে ...মাননীয় রাজপুত্র, সঠিক সময়ে অফিসে উপস্থিত হতে পারিনি। ক্ষমা চাই।' 


-‘প্রথমদিনই লেইট করাটা কোনও সিনসিয়ার এমপ্লয়ির লক্ষণ নয়।’ 


-’দুঃখিত। আর হবে না এরকম।’  


-’গাড়িতে উঠে বসুন।’


-’হ্যাঁ?’ মেহেরু চমকায়। 


তুর্যয় শীতল একটা দৃষ্টি মেহেরুর ওপর নিক্ষেপ করে ড্রাইভারকে বলল, ‘ইনাকে গাড়িতে উঠে বসতে বলো।’ 


লিমোজিনে জীবনে এই প্রথমবারের মতো উঠল মেহেরু। কত্ত বড় কম্পার্টমেন্টরে বাবা! যেন ট্রেনের ফার্স্ট ক্লাস কুপে কামরা। এই গাড়ির ভেতরে যে কেউ অনায়াসে সংসার পেতে বসতে পারবে। আলাদা বাড়িঘর লাগবে না। সম্মুখের প্রশস্ত গদিতে তুর্যয় বসেছে। ওর সামনে একটা লম্বাটে টেবিল। মেহেরু টেবিলের উল্টো পাশের গদিতে উঠে বসতেই গাড়ির দরজা বন্ধ হয়ে গেল। তারপর লিমোজিনের অভিজাত সুপ্রশস্ত কম্পার্টমেন্টে শুধু ওরা দুজন ব্যতীত আর কেউ রইল না।  


-------- 


যারা উপন্যাস কন্টিনিউ করার জন্য অনুরোধ করেছিলেন তাদের জন্যই আবার দেয়া হলো। এই উপন্যাসের ক্যানভাস অনেক বিস্তৃত। আমার রব রাজি থাকলে যাত্রা হবে সুদীর্ঘ। রাজকন্যা, রাজা রাণির অতীত, রাজবংশীয় ইতিহাস, কোনোটাই বাদ পড়বে না ইন শা আল্লাহ। বাদ পড়বে না রাখাল ছেলে ইশানও। আগে শুধু চরিত্র আর পারিপার্শ্বিকতা চিত্রায়ন করেছি, এবার গড়তে যাচ্ছি একটা গোটা রাজ্য! ব্যাপারটা কঠিন। হয়তো দক্ষতার সাথে পারব না ফুটিয়ে তুলতে, তবে চেষ্টায় বাঁধা কোথায়? পাঠকের ধৈর্য ধরতে হবে। কিন্তু পাঠক নীরবতা পালন করে গেলে লেখা অনলাইনে নিয়মিত আসবে না।

No comments

Powered by Blogger.