গল্প | উড়ান মেঘের দেশে - পর্ব-১৩ | Oran megher deshe - Part-13
লেখিকা-ওয়াসিকা নুযহাত

মেহেরু স্তব্ধীভূত চোখে চেয়ে ছিল খানিক দূরে বসা সদ্য কৈশোর পেরোনো সপ্রতিভ, বাকপটু এবং অগ্নিবৎ সাহসী তরুণটির দিকে। সমাজে কিছু নিয়ম থাকে, যে নিয়মগুলো কখনো ভাঙা যায় না, ঠিক তেমনি
কিছু কিছু কথা থাকে যে কথা গুলো চিরকালের জন্য নিষিদ্ধ এবং অনুচ্চার্য, এই সাধারণ বাস্তব জ্ঞানটুকু যার ঘটে নেই, সংসারে তার মতো বিপজ্জনক মানুষও আর দ্বিতীয়টি নেই। মেহেরুর মুখখানা অপমানে থমথম করছিল। সে ভাবতেই পারেনি তুর্যয় ফট করে এমন অনৈতিক আবদার করে বসবে। রাজার কুমার হয়েছে বলেই কি যা মুখে আসবে বলে বসবে? কোনো ভদ্রতার বালাই নেই? যেসব পুরুষ দিনরাত ওর দিকে লোভী চোখে তাকায়, তুর্যয়ও তবে সেইসব পশুতুল্য, কামার্ত, লম্পট পুরুষদের কাতারেই পড়ে গেলো? পুরুষরা কি কখনও মানুষ হয় না? শুধু নিরাপদ বন্ধু হয়ে, মনের মতো সঙ্গী হয়ে একজন নারীর পাশে থাকাটা কি খুব কষ্টের?কী এমন ক্ষতি হত তুর্যয়, যদি তুমিও আর দশটা পুরুষের মতো সস্তা না হতে ... আমার এই বান্ধবহীন নিরানন্দ জীবনে তুমিই তো একমাত্র সুহৃৎ মিত্র ছিলে। কত মধুর, কত স্নিগ্ধ ছিল তোমার সাথে কাটানো সময়গুলো। কী এমন ক্ষতি হত যদি এই নিকৃষ্ট আবদারটা আজ তুমি না করতে …… !
বসা থেকে উঠে পড়ল মেহেরু। দুই ধাপ সিঁড়ি বেয়ে ওপরে উঠতেই তুর্যয় পেছন থেকে খপ করে ওর ডান হাতের কব্জিটা খামচে ধরল। পুকুরঘাট নির্জন, নিস্তব্ধ। শ্বেতপাথরের সাদা ঘাট কৃষ্ণচূড়ার লাল পাপড়িতে ভরে গেছে। মাঝে মাঝে নীহারিকা দাসীদের সঙ্গে নিয়ে এদিকটায় ফুল কুড়াতে আসে। এই মুহূর্তে যদি কেউ চলে আসে তাহলে কী উপায় হবে? মেহেরুর বুকটা এক অবিদিত ভয়ে কাঁপছিল। সে তুর্যয়ের মুঠো থেকে নিজের কব্জিটা প্রাণপণে ছাড়িয়ে নেবার চেষ্টা করে বলল, ‘হাত ছাড়ো!’
তুর্যয় ওকে ছাড়ল না বরং আরও সবল হাতে পিছমোড়া করে চেপে ধরল কব্জি খানা। মেহেরুর মুখ সামনের দিকে তাক করা, চোখে অস্বস্তি, ভয় এবং উৎকণ্ঠা। তুর্যয় ওর কানের কাছে মুখ নামিয়ে বলল, ‘এরকম করছ কেন?’
-’হাত ছাড়ো, ব্যথা পাচ্ছি।’
তুর্যয় ওকে নিজের দিকে ঘুরিয়ে নিল, হাতটা ছাড়ল না।
-’মালাটা তুমি কিনবে না?’
মেহেরু অন্যদিকে মুখ ঘুরিয়ে নিল, ‘না।’
-’কেন?’
-’তুর্যয়! ছেলেমানুষি করো না। হাত ছাড়ো, কেউ দেখে ফেলবে।’
-’দেখলেই কী? আমি ভয় পাই নাকি কাউকে?’
-’তুমি পাও না তা জানি, কিন্তু আমি পাই।’
মেহেরুর চিবুকে একটা হাত রেখে তুর্যয় বজ্রকন্ঠে বলল, ‘এদিকে তাকাও। আমার দিকে তাকাও।’
মেহেরু তাকালো না। চোখজোড়া ক্রোধের স্ফুলিঙ্গ নিয়ে মুখ ঘুরিয়ে রাখল অন্যদিকে। তার গালে রক্তের আঁচড় লেগেছে। ঠোঁট কাঁপছে থরথরিয়ে।
-’মালাটা তুমি কিনতে চাইছ না কেন?’ তুর্যয়ের একরোখা প্রশ্ন।
-’সামর্থ্য নেই।’
-’বেশ তো … যদি অন্য কেউ কিনে নেয়?’
এই কথায় কী ছিল তা আজও জানে না মেহেরু, কিন্তু কথাটা শোনামাত্র এক চমকসমৃদ্ধ বিচিত্র শিহরণ খেলে গিয়েছিল শিরদাঁড়া বেয়ে। চকিতে তার ঘাড় ঘুরে গিয়েছিল স্প্রিং এর মতো। তুর্যয় এখন খুব কাছে। চার পাঁচ ইঞ্চি উঁচু থেকে মেহেরুর মুখের ওপর ঝুঁকে আছে ওর মুখ। সেই মুখে তেজসমৃদ্ধ দুর্নিবার সাহসের ঝংকার ....... উন্নত নাক, সবুজ আভাযুক্ত চন্দন রঙের টকটকে ফর্সা গাল ...ধূসর ভাসা ভাসা চোখদুটি থেকে একটা দিব্য দ্যুতি ঠিকরে বেরোচ্ছে ..... ওই চোখ আয়নার মতো ঝকঝকে স্বচ্ছ! তাকালে যেন পুরো হৃদয়টা নিমেষে পড়ে ফেলা যায়! আজকের এই ঘুঘু ডাকা চৈত্রের বিকেলে, ওদিকে তাকানো মাত্র মেহেরুর মনে হলো ওই চোখের মধ্যে তার জন্য একটি বিশেষ রকমের দরজা আছে, সেই দরজা দিয়েই একমাত্র মুক্ত আকাশের আস্বাদ পাওয়া যায়! এমন নির্মল, মুক্ত দুয়ার যে তরুণের চোখে থাকে, তার সাথে পৃথিবীর অন্য কোনও পুরুষের তুলনা চলে না।
-’সবকিছু দাম দিয়ে কেনা যায় না তুর্যয়! এটা বোঝ না বলেই তুমি এখনও ছেলেমানুষ!’
তুর্যয় একটি হাত মেহেরুর মাখনের মতো মসৃণ গালের ওপর রেখে স্থির কণ্ঠে বলল, ‘আমি এখন আর ছেলেমানুষ নই। জলপরী শোন! এই মালাটা কেনার সামর্থ্য যদি তোমার না থাকে, তবে এই সামর্থ্য পৃথিবীর অন্যকোনো মেয়েরই কখনও হয়ে উঠবে না।’
এখন আশেপাশে কেউ নেই। মেহেরু চাইলেই মন্ত্র পড়ে জাদু দিয়ে এই তরুণটিকে বশে আনতে পারে। তারপর এক ছুটে পালিয়ে যেতে পারে ত্রিসীমানা থেকে। কিন্তু সে এমন কিছুই করছে না। কারণ জীবনে প্রথম বারের মতো মনে হচ্ছে তাকেই যেন জাদু দ্বারা বশ করা হয়েছে। এই জাদুর জন্য মন্ত্রের শক্তি লাগে না। প্রণয়ের সুর এসে হৃদয় তন্ত্রী স্পর্শ করলে আপনাআপনি এই জাদু কার্যকরি হয়ে যায়। তুর্যয় ওর দিকে নিবিঢ় এক ঘোরলাগা চোখে চেয়ে ছিল। কী সুন্দর ওই ধূসর চোখের ঝকঝকে চাউনি! যেন জলরঙে আঁকা। মেহেরুর হঠাৎ মনে হল একটা নির্দোষ চুম্বনে বুঝি পৃথিবীর কিছুই এসে যায় না। এই পদ্মপুকুরের এক টুকরো চৈত্র বিকেলটা হয়তো তার অভিশপ্ত জরাজীর্ণ জীবনের কোন অংশ নয়। এই বিকেলটা এক খণ্ডিত স্বর্গ। এই স্বর্গে সে তার ভালোলাগার পুরুষকে কাছে চাইতেই পারে। তুর্যয়ের মুখটা ওর মুখের ওপর নেমে আসছিল, ঠিক সেই সময় জঙ্গলের গাছগাছালির ভেতর থেকে মড়মড় করে একটা পদশব্দ ভেসে এলো। চমকে উঠে এক ধাক্কায় তুর্যয়কে দূরে সরিয়ে দিল মেহেরু। ধাক্কায় জোর ছিল অনেক। তুর্যয়ের শরীরটা পিছিয়ে আসল, কৃষ্ণচূড়ার পাঁপড়ি ছড়ানো পিচ্ছিল সিঁড়িতে ফসকে গেলো পা। ঝপাং করে পড়ল জলে। মেহেরু এক ছুটে পালিয়ে গেলো জায়গাটা থেকে। জঙ্গলে ওটা কার পায়ের শব্দ ছিল সেই রহস্য আজীবনের জন্য অমীমাংসিতই রয়ে গেলো তার কাছে।
চোখের জল যখন বালিশ ভিজিয়ে দিল তখন মেহেরু টের পেলো সে কাঁদছিল। কী আশ্চর্য! কেন কাঁদছে? পাগল নাকি! ধুর ছাই! ঘুম কেন আসছে না … কেন যে এতো ক্লান্তির পরেও ঘুম আসছে না!
শহরতলির ঘিঞ্জি গলির পুরনো বাসার মলিন বিছানায় মেহেরুর যে কারণে ঘুম আসছিল না, ঠিক একই কারণে ঘুম আসছিল না পাহাড়চূড়ার ওই রাজপ্রাসাদের এক স্বপ্নবিলাসী যুবকেরও। প্রথম প্রেমের প্রত্যাখ্যান আর দশটা স্বাভাবিক তরুণ প্রাণেরই মতো সমুদ্রকুঞ্জের রাজকুমারকে চরম ভাবে আঘাত করেছিল। এই আঘাত মেনে নিতে এতটাই কষ্ট হয়েছিল যে তাকে শেষ অবধি দেশছাড়া হতে হলো। কৈশোরে এবং তারুণ্যে অনেক ভালোলাগা ঝড়ের মতো সশব্দে আসে আবার নিঃশব্দে প্রস্থান করে। কিছু মানুষ টেরও পায় না এই আসা যাওয়ার গোপন খেলা। কিন্তু তুর্যয় ব্যতিক্রম। এক মুহূর্তের জন্যও সেদিনের অপমানটা ভুলতে পারেনি সে। তার বুকের মধ্যে একটি মাত্র মুখ মোমবাতির আলোর মতো তিরতির করে জ্বলে যাচ্ছে বহুদিন ধরে। সেই মোমের আগুনে ওই মুখটা একটু খানিও পোড়ে না। পোড়ে শুধু তার মন। রংতুলির ক্যানভাসে ওই মুখ আঁকার চেষ্টা করেছে বহুবার। কিন্তু প্রকৃত মাধুরীটুকু কিছুতেই ফুটিয়ে তোলা সম্ভব হয়নি। সম্ভব হবেও না কখনও! সুসজ্জিত, নব সংস্কারকৃত রাজকীয় মহলের সুপ্রশস্ত কক্ষে, রৌপ্যচূর্ণ খচিত অভিজাত পালঙ্কে শুয়ে থেকে তুর্যয় ভাবছিল মানুষ আসলে মনের দিক দিয়েই ধনী হয়, আবার মনের দিক দিয়েই হয় দরিদ্র। তার জীবনে কোন কিছুর অভাব নেই। সাত কোটি জনগণ অধ্যুষিত একটি গোটা রাজ্যের যুবরাজ হতে যাচ্ছে সে, রাজ্যের মানুষের কাছে সে দেবতুল্য একজন। তবুও তার ভেতরটা এমন নির্ধন ফকিরের মতো সুনসান কেন? বাইরের এই জাঁকজমক রাজকীয় জীবন কি সে আদৌ চেয়েছিল? একটা দীর্ঘ নিশ্বাস পাক খেয়ে উঠে আসে ভেতর থেকে। গানের কলি গুনগুন করে মনে। সেই গানের কথাগুলোর মতো তারও বলতে ইচ্ছে করে,
কিচ্ছু চাইনি আমি আজীবন ভালবাসা ছাড়া
আমিও তাদেরই দলে বারবার মরে যায় যারা ……
---------------------------
আর্ত চিৎকারটা কানে আসা মাত্রই অজয় সুড়ঙ্গের খাঁড়া সিঁড়িতে নেমে পড়ল। সিঁড়ি অন্ধকার। কিন্তু ভুগর্ভস্থ গুপ্ত কুঠুরির দ্বার খোলা থাকায় কিছুটা হলদে আলো ছিটকে এসে পড়েছে শেষের ধাপ গুলোয়। অজয় খুব দ্রুত নিচে নেমে এলো। নামতেই যে দৃশ্যটা দৃষ্টিগোচর হলো সেই দৃশ্যের জন্য সে একেবারেই প্রস্তুত ছিল না। হঠাৎ এক অনাহূত উৎকট ক্রোধের প্রাবল্যে তার শরীরের প্রতিটি শিরা উপশিরা ঝলসে উঠল। স্ফীত হলো কপালের নীল রগ, চোখের দৃষ্টি ক্রুর। হিংস্র হায়েনার মতো ঝাঁপিয়ে পড়ল সে ঘরে উপস্থিত কামুক এবং ধর্ষক পুরুষটির ওপর। হঠাৎ যেন আকাশ থেকে জলজ্যান্ত এক দৈত্য ঝাঁপিয়ে পড়েছে। রাশিকার মুখ চেপে ধরে থাকা তরুণটি ভয় পেয়ে ছিটকে গেছে অন্যদিকে। প্রায় মরণাপন্ন, আতঙ্কিত রাশিকা যেন সাক্ষাত মৃত্যুর হাত থেকে মুক্তি পেয়ে সঙ্গে সঙ্গে উঠে বসল। তার হাতের কব্জি থেকে রক্ত ঝরছে। পরনের কাপড় কাঁধের দিকে ছেঁড়া। পাজামা হাঁটু পর্যন্ত নামানো। মুখে রক্তের কোন চিহ্ন নেই। সাদা ফ্যাকাশে মুখ দেখে মনে হয় যেন মরা মানুষের চামড়া। কম্পিত, ভীত সন্ত্রস্ত হাতে পাজামা ধাতস্থ করতে করতে সে ঘোলা চোখে দেখতে পেল এক দীর্ঘকায় যুবক সিংহের মতো গর্জনরত অবস্থায় মধ্যবয়স্ক ধর্ষক পুরুষটিকে টেনে হিঁচড়ে অন্যদিকে নিয়ে যাচ্ছে। যুবকটি যেন ক্রোধে পাগল হয়ে গেছে। রাশিকা কখনও কোনও মানুষকে এমন আগ্নেয়গিরির মতো বিকট রাগে ফেটে পড়তে দেখেনি আগে। খানিক বাদেই সে ছেলেটাকে চিনতে পারল। এই সেই রাজপুত্র। যে তাকে বন্দি করার আদেশ দিয়েছিল। ঘরে উপস্থিত তরুণ তখন পড়িমরি করে ছুটে পালিয়েছে। হঠাৎ একটা কাণ্ড ঘটল। অজয় সেই ধর্ষক পুরুষটির গলার ওপর পাঁচ আঙ্গুল অত্যন্ত জোরালো ভাবে বসিয়ে দিল। তার শরীরে এখন আসুরিক শক্তি। এই শক্তির উৎস কোথায় সে জানে না। শুধু শক্তির প্রয়োগটাই জানে। রাশিকা স্তব্ধ চোখে চেয়ে আছে। তার নিশ্বাস পড়ছে না। এদিকে অজয়ের হাতের মুঠোয় বন্দি লোকটার চোখ কোটর থেকে বেরিয়ে এসেছে। জিব ঝুলে পড়ার দশা। হঠাৎ মট করে হাড় ভাঙার শব্দ হলো। বদ্ধ কুঠুরির চার দেয়ালে ধাক্কা খেয়ে প্রতিধ্বনিত হলো সেই মর্মান্তিক শব্দ। আর্তনাদ করে উঠল রাশিকা গা শিউরে ওঠা বীভৎস ভয়ে। ঘটনাটা ঘটে যাবার পরমূহুর্তেই অজয়ের হাতদুটি শিথিল হয়ে এলো। থমকে গেলো ক্রোধের স্ফুরণ। সে টের পেলো ...এইমাত্র তার হাতে একজন মানুষ খুন হয়ে গেছে!
-------
এখন থেকে ছোট পর্ব দেব।
No comments