গল্প | উড়ান মেঘের দেশে - পর্ব-০৯ | Oran megher deshe - Part-09
লেখিকা-ওয়াসিকা নুযহাত

রাশিকা বশীভূত, বিহ্বল এবং নিমিষহারা চোখে চেয়ে আছে তার স্বপ্নের রাজকুমারের দিকে। অন্যান্য বাবুর্চিদের কেউই এই মুহূর্তে প্রাসাদের বাইরে অবস্থান করছে না। রাশিকা ব্যতিক্রম। সে অ্যাপ্রন এবং শেফ হ্যাট পরেই সারিবাঁধা কর্মচারীদের ভিড়ে দাঁড়িয়ে গেছে। একটি আহ্লাদী হাসির ঝিলিকে তার চোখ মুখ উদ্ভাসিত। কালো রঙের লিমো রাজভবনের সম্মুখে এসে দাঁড়িয়েছে। তুর্যয় গাড়ি থেকে অবতরণ করছে ভাই-বোনদের সঙ্গে নিয়ে। উত্তেজনার বশে রাশিকা দম নিতে ভুলে গেছে। তার শিরদাঁড়া দিয়ে বয়ে যাচ্ছে আনন্দ মিশ্রিত এক শিরশিরে শিহরণ! উপস্থিত কর্মচারীরা সবাই মাথা নুইয়ে কুর্নিশ করল। রাশিকার বাস্তব জ্ঞান তখন লোপ পেয়েছে।কুর্নিশ করার কথা তার মাথায়ই এলো না। নিশ্চল পাথর হয়ে দাঁড়িয়ে রইল। স্বাভাবিক ভাবেই তুর্যয়ের চোখ পড়ল এই ব্যতিক্রম, উচ্ছল, পাগলাটে তরুণীটির দিকে। চোখাচোখি হতেই রাশিকা হাত নেড়ে বিগলিত, আপ্লুত কণ্ঠে বলল, ‘হ্যালো, ডিয়ার প্রিন্স চার্মিং!’
উপস্থিত লোক সকল বিস্ফারিত নেত্রে চমকে তাকালো তার দিকে। তাকানোর ভঙ্গি অত্যন্ত রাগী এবং কঠোর। তুর্যয় কিন্তু রাগলো না। বরং রাগের পরিবর্তে তার ঠোঁটে ফুটে উঠল প্রশ্রয়মিশ্রিত এক ঝকঝকে হাসি। ক্ষণকাল অতিবাহিত হবার পর রাশিকা এই বাস্তবতা টুকু বুঝতে সক্ষম হলো যে রাজকুমারের হাসিটা আদতে তার জন্যই ছিল। আনন্দে তার ভেতরটা একদম উথাল পাথাল করতে লাগল, যেন আরেকটু হলেই প্রাণবায়ু নির্গত হয়ে যাবে।
সবাই উচ্চস্বরে উলু দিয়ে যাচ্ছে। রানিমা দাঁড়িয়ে আছেন প্রাসাদ তোরণের সামনে। তুর্যয় এগিয়ে গেলো মায়ের কাছে। তার সাথে বিজয়, নীহারিকা এবং রিয়া আছে। ওদের সকলের গায়ের ওপর ফুলের পাঁপড়ির বৃষ্টি হচ্ছে। বেজে চলেছে ব্যান্ডের বাজনা। সেই সাথে উলুর নিরবচ্ছিন্ন শব্দ। কানে তালা লেগে যাবার যোগাড়। এই হট্টগোলের মধ্যেই কপালে তিলক এঁকে পুত্রকে বরণ করলেন মহারানি উর্মিলা। মহারাজ পুত্রের জন্য অপেক্ষা করছেন নিজ কক্ষে। তাই বরণ প্রক্রিয়ায় খুব বেশি সময় অতিবাহিত না করে উর্মিলা অতি দ্রুত পুত্রকে নিয়ে মহলের অভ্যন্তরে প্রবেশ করলেন।
এদিকে রাজার কুমারের তৃষিত ধূসর নয়নজোড়া সেই তখন থেকে বিশেষ একজনকে খুঁজে বেড়াচ্ছিল। কিন্তু এতো লোকের ভিড়ের মাঝে সেই বিশেষ মানুষটির মুখ সে এখন অবধি আবিষ্কার করতে পারেনি।
মেহেরু ভিড় থেকে একটু দূরে সরে এসেছিল। মানুষের কোলাহল, ব্যান্ডের বাজনা, নিরর্থক হৈচৈ …… এতো রকম শব্দের মাঝে তার কেমন দম আটকে আসছে। মনে হচ্ছে মুক্ত হাওয়াছ শ্বাস নেয়া প্রয়োজন। সে মহলের পেছন দিকের অলিন্দে এসে দাঁড়িয়েছে। মহলগুলো এত বড় যে মাঝে মাঝে ভুল ভুলাইয়া মনে হয়। এই মুহূর্তে মেহেরু রেলিঙের ধার ঘেঁষে দাঁড়িয়েছে। সামনেই বাঁশঝাড়। বাঁশঝাড় পেরিয়ে কিছুদূর এগোলেই পদ্মপুকুর। এই পুকুরটা ভারী সুন্দর। চারপাশে নারকেল গাছ আর কৃষ্ণচূড়ার সমারোহ। সাদা রঙের শ্বেতপাথরের বাঁধানো ঘাট। পানি এতো স্বচ্ছ যে খালি চোখে মাছের সাঁতরে বেড়ানো দেখা যায়। পাঁচ বছর আগে এই পুকুর ঘাটে তুর্যয়ের সাথে তার শেষবার দেখা হয়েছিল। বিশেষ কোনও ঘটনা নয়, তবুও কেন যে আজ এতোদিন বাদে তুচ্ছ ঘটনাটা অমন বিশেষ ভাবে মনে পড়ছে, কে জানে! বিনা কারণে তার বুক ধড়ফড় করছে। হাঁসফাঁস লাগছে। কী হাস্যকর ব্যাপার! তুর্যয় তার চেয়ে বয়সে কত ছোট! অল্প-বয়সী একটা ছেলের সামনে গিয়ে দাঁড়াবার কথা চিন্তা করে এমন অবাধ্য আড়ষ্টতায় পেয়ে বসা কি তার মতো প্রাপ্তবয়স্কা রমণীকে মানায়? পাঁচ বছর আগে এই পুকুর ঘাটে ঘটে যাওয়া ঘটনাটি নিশ্চয়ই তুর্যয় আর মনে রাখেনি। সে যদি মনে না রাখে তাহলে মেহেরুর মিছিমিছি বিব্রত হওয়ার কোনও কারণ নেই। সে খোলা হাওয়ায় দীর্ঘ শ্বাস টেনে নিয়ে বুকের মধ্যে সাহস সঞ্চয় করল। তারপর প্রবেশ করল মহলের অভ্যন্তরে। এদিকে বিশাল বড় লম্বা করিডোর। পায় বিশ ফিট উঁচু ছাদের সিলিং এ শোভা পাচ্ছে রুচিশীল কারুকার্য। পায়ের নিচে মার্বেল পাথরের সাদা কালো চৌখপ্পির ঝকঝকে পিচ্ছিল মেঝে। লম্বা করিডোরের কিছু দূর পর পর বিশাল বড় কার্নিশ সম্বলিত গবাক্ষ। সেইসব গবাক্ষে পুরোনো আমলের মোটা মোটা লোহার গরাদ। প্রতিটি গবাক্ষ ঘিরে রয়েছে খুপরির ঘরের মতো প্রশস্ত স্থান। করিডোরের দেয়ালে লটকে আছে অনেকগুলো মশাল জ্বালাবার স্ট্যান্ড। ওগুলোতে এখন আর মশাল জ্বলে না। রাতের বেলা বৈদ্যুতিক আলোতে ঝকঝক করে চারপাশ।
এদিকটায় কেউ নেই এই মুহূর্তে। দাসি বাঁদি সকলেই রাজার কুমারকে বরণ করে নেয়ার আয়োজনে মত্ত। তবে কেউ একজন আশেপাশে মেঝে ঝাঁট দিচ্ছে ঝাড়ুতে খসখস শব্দ তুলে। এখন বাতি জ্বলছে না। খোলা জানালা দিয়ে বিকেল বেলার নরম আলো এসে হুমড়ি খেয়ে পড়েছে প্রলম্বিত করিডোরের মার্বেল পাথরের চাকচিক্যময় মেঝেতে। কয়েকটা কবুতর উড়ে বেড়াচ্ছে উঁচু বীমের খাঁজে। বাইরের কোলাহল অর্ধ বিস্মৃত সুদূর জনশ্রুতির মতো কানে এসে লাগছে। হঠাৎ ডান পাশের গবাক্ষ সম্বলিত খুপরি স্থানটিতে একটি ছায়া পরিলক্ষিত হল। থমকে গেলো মেহেরু। একজন লম্বা চওড়া ষণ্ডা চেহারার প্রৌঢ় পুরুষ দৃশ্যপটে উপস্থিত হল। তার পরনে সাধারণ পোশাক। সে পকেট থেকে একটা আইডি কার্ড বের করে মেহেরুর মুখ বরাবর তাক করে বলল, ‘দুঃখিত। আপনাকে বেশ কিছুক্ষণ ধরে ফলো করছিলাম। সকাল থেকে বহুবার আপনার ফোন নাম্বারে কল করা হয়েছে। আপনি ধরেননি। তাই বাধ্য হয়ে রাজবাড়িতে আসতে হলো। আমি পুলিশের লোক। আপনাকে একবার থানায় যেতে হবে।’
-কেন?’ শঙ্কিত কণ্ঠে প্রশ্ন করে মেহেরু।
পুলিশের লোকটা চারপাশে একবার সতর্ক দৃষ্টি ফেলে গলা খাদে নামিয়ে বলল, ‘একজন উন্মাদ মহিলা গতকাল পুলিশ স্টেশনে মৃত্যু বরণ করেছে।’
-’এসব আমাকে বলছেন কেন? আমি কী করব?’
-’সেই মহিলা মৃত্যুর আগে আপনার জন্য একটা নোট লিখে রেখে গেছে।’
-’আমার জন্য? কে এই মহিলা? আমি তো চিনি না!’
-’বিষয়টি এখন পর্যন্ত গোপন আছে। ওসি সাহেব ব্যাপারটা নিয়ে আপনার সাথে সরাসরি কথা বলতে চান। নোটটাও এই মুহূর্তে তাঁর কাছেই আছে। আপনি প্লিজ চলুন।'
---------------------------
মহারাজ শয়ন কক্ষ সংলগ্ন ক্ষুদ্র বৈঠক-খানায় বসে আছেন। তাঁর পরনে একটি ঘিয়া রঙের ফতুয়া। সাদা পাজামা। বাম পাশে একজন ভৃত্য দাঁড়িয়ে আছে হুঁকোর পাত্র হাতে নিয়ে। মহারাজের কপালে চিন্তামিশ্রিত কুঞ্চন। বড় পুত্রের আগমনে তিনি আনন্দিত, কিন্তু প্রথম দিনেই তুর্যয় তাঁকে বিব্রতকর পরিস্থিতিতে ফেলে দিয়েছে। রাজবংশর ঐতিহ্য রক্ষায় তুর্যয়ের উদাসীনতা প্রসঙ্গে স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী দুরালাপনির মাধ্যমে ক্ষণকাল আগে মহারাজের কাছে ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন।
স্ত্রী এবং পুত্র ঘরের ভেতর প্রবেশ করতেই মহারাজ ভৃত্যটিকে ইশারায় বেরিয়ে যেতে বললেন। তুর্যয় পিতাকে জড়িয়ে ধরল। এই কক্ষটি খুব বেশি প্রশস্ত নয়। একটি বিশালাকৃতির কারুকার্যখচিত সেগুন কাঠের টেবিল একাই বলতে গেলে পুরো স্থান দখল করে রেখেছে। টেবিলের ওপর দুনিয়ার কাগজ এবং বইপত্র। এক কোণে একটি বহু পুরোনো এনটিক টেলিফোন। এই মুহূর্তে বাতায়নের পাল্লা খোলা। বাইরের মনোরম বিকেলের ঝরঝরে রোদ মাখানো আলোতে উদ্ভাসিত হয়ে আছে চারপাশ। মহারাজ উঠে দাঁড়িয়ে পুত্রকে জড়িয়ে ধরেছিলেন। আলিঙ্গন পর্ব শেষ হবার পর পুনরায় আসন গ্রহণ করলেন। মাতা পুত্রও চেয়ার টেনে নিয়ে বসল, মহারাজের মুখোমুখি।
-’কেমন লাগছে? এতদিন পর দেশে ফিরে এসে?’ প্রশ্ন করলেন মহারাজ, পুত্রের চোখে চেয়ে।
তুর্যয়ের মুখে খানিক আগের হাসিটা এখন আর নেই। তার চিত্ত উদ্বিগ্ন এবং অস্থির। একজন মানবীকে এক ঝলক দেখতে পাবার দুর্মর আশা নিয়ে প্রাসাদ প্রাঙ্গণে পা রেখেছিল। এতো লোক তাকে সাদর সম্ভাষণে বরণ করে নিল, কিন্তু সেই মানবীর ছায়া টুকুরও দেখা মিলল না। অথচ তুর্যয় খুব ভালো মতোই জানে রাজবাড়ির সেবায় সে আজও নিয়োজিত আছে। এই উপেক্ষা নিশ্চয়ই ইচ্ছাকৃত। পাঁচ বছর আগের অপমানটা তুর্যয় এখনও ভুলতে পারেনি। আজকের এই উপেক্ষাও কি এক ধরণের অপমান নয়? মনের অস্থির ভাবটা লুকিয়ে রেখে যথাসাধ্য স্বাভাবিক গলায় বলল, ‘ভালো লাগছে বাবা। ভীষণ ভালো লাগছে।’
উর্মিলা পুত্রের উষ্কখুষ্ক চুল হাত দিয়ে ভদ্রস্থ করে দিয়ে বললেন, ‘তোমার সাজপোশাকটা আজ মোটেও ঠিক হয়নি। রাজপুত্ররা এরকম সাধারণ জামা কাপড় পরে নাকি?’
তুর্যয় মায়ের কথা শুনে সকৌতুকে বলল, ‘এর মানে আপনারা বলতে চাইছেন, আমার স্যুটেড বুটেড হয়ে প্লেনে ওঠা উচিত ছিল?’
-’ফর্মাল শার্ট প্যান্ট তো পরতে পারতে নাকি?’
তুর্যয় হতাশ নিশ্বাস ছাড়ল ,’মাথায় আসেনি মাতা-রানি! ক্ষমা করুন!’
মহারাজ স্ত্রীর দিকে চেয়ে তীক্ষ্ণ কণ্ঠে বললেন, ‘তুমি স্মরণ করিয়ে দাওনি কেন? দোষ তো তোমার।’ সন্তানদের সামনে তিনি স্ত্রীকে তুমি সম্বোধন করেন। একান্ত ব্যক্তিগত সময়ে সম্বোধনটা 'তুই' তে নেমে যায়।
উর্মিলা স্বামীর কথায় কোনও রা করলেন না। তাঁদের স্বামী স্ত্রীর মধ্যে একটি শীতল ভাব বিরাজ করছে আজ সকাল থেকে। মহারাজ রাতে আসবেন বলে কথা দিয়ে আসেননি। কী কারণে আসেননি সেই বিষয়ে কিছু বলতেও নারাজ তিনি। জানতে চাইলে বারংবার বলছেন, ‘স্মরণে আসছে না। মনে নেই আমার!’
তুর্যয়কে দেখে মনে হচ্ছে সে কিছু একটা নিয়ে চিন্তিত। তার ভাসা ভাসা ধূসর দুটি চোখের দৃষ্টি, চঞ্চল এবং আনমনা। ফর্সা গালে লালচে রঙের দুশ্চিন্তার আভাস। এই মূহুর্তে সে পিতা মাতার মুখের দিকে চেয়ে নেই। চেয়ে আছে বাতায়নের বাইরের বিকেল রঙের আকাশের দিকে।
মহারাজ বললেন, ‘তুমি নিশ্চয়ই শুনেছ যে আমার হাতে আর খুব বেশিদিন সময় নেই।’
তুর্যয়ের যেন সম্বিৎ ফিরল। ঘাড় ঘুরিয়ে পিতার মুখ পানে চেয়ে সে বলল, ‘আপনার মেডিকেল রিপোর্ট গুলো আমাকে একটু দেখাবেন, বাবা?’
-’সে নাহয় দেখবে। আগে আমার কথাটা শুনে নাও।’
-’জি বলুন।’
-’আমার মৃত্যুর পর বয়োজ্যেষ্ঠ সন্তান হিসেবে সিংহাসনের উত্তরাধিকার হতে যাচ্ছ তুমি। হংসমণি রাজবংশের উনিশতম শাসক। তুমি কি এই গুরুদায়িত্ব গ্রহণ করার জন্য প্রস্তুত?’
তুর্যয় খুব সপ্রতিভ স্বভাবের ছেলে। উত্তরটা যেন তার মুখে তৈরি করা ছিল। একটুও সময় নষ্ট না করে ঝটপট বলে ফেলল, ‘একেবারেই প্রস্তুত নই বাবা। আপনাকে আমাদের সাথে আরও অনেকদিন থাকতে হবে। হুট করে চলে গেলে তো হবে না।’
মহারাজ একটা দীর্ঘশ্বাস মোচন করে বললেন, ‘আবেগের কথা এখন থাক। রাজকার্য পরিচালনা করার প্রথম এবং প্রধান শর্ত হলো সস্তা আবেগ অনুভূতির বিসর্জন দেয়া। বাৎসল্যের মতো দুর্বলতা রাজ রাজড়াদের মানায় না।’
তুর্যয় এ কথার প্রেক্ষিতে কিছু বলল না। চুপ করে রইল।
মহারাজ কিঞ্চিৎ গম্ভীর গলায় বললেন -’প্রথম দিনেই তোমার নামে অসন্তোষজনক মন্তব্য এসেছে সরকারি দপ্তর থেকে।’
তুর্যিয় একটু চমকালো, ‘তাই নাকি?’
মহারাজ চেয়ারের পিঠে হেলান দিয়ে বসে ছিলেন এতক্ষণ। এবার শিড়দাঁড়া সোজা করে বসলেন, একটু কেশে গলা পরিষ্কার করে নিয়ে বললেন, ‘হ্যাঁ তাই। তুমি ঘোড়ায় চড়তে আপত্তি জানিয়ে রাজকীয় নিয়মকে অসম্মান করেছ। কাজটা ঠিক করোনি।। রাজ বংশের ঐতিহ্য রক্ষায় তোমার ভূমিকা আরও সক্রিয় হতে হবে। এরকম হলে তো আমাদের শত বছরের ট্র্যাডিশন ধূলোয় মিশে যাবে। কিছুই অবশিষ্ট থাকবে না আর।’
তুর্যয় অপরাধী গলায় বলল, ‘ক্ষমা করবেন মহারাজ। কিন্তু আমার কাছে রাজকীয় নিয়ম রক্ষার চাইতে নিজের স্বস্তিটুকুই গুরুত্বপূর্ণ মনে হয়েছিল।’
-’রাজ্য চালনা করতে হলে নিজেকে ভুলে যেতে হবে। দশের সেবায় স্বার্থ ত্যাগ করতে হবে।’
-’সেটা বুঝেছি। কিন্তু আমার ঘোড়ায় না চড়ার কারণে কার স্বার্থের ক্ষতি হলো বুঝলাম না। আমি তো জন সাধারণের কোনও ...।।’
মহারাজ পুত্রকে মাঝপথে থামিয়ে দিয়ে কড়া গলায় বললেন, ‘তুর্যয়! দেশীয় সংস্কার ভুলে গেলে চলবে না। এই দেশের মানুষ কিন্তু এমনিতেই তোমাকে আজকাল বিদেশি ভাবতে শুরু করেছে। অনেকে অজয়কেই ভবিষ্যৎ শাসক হিসেবে চায়। তোমাকে নয়।’
তুর্যয় এ কথা শুনে পরিষ্কার গলায় বলল, ‘অজয়কেই নাহয় ক্রাউন প্রিন্স ঘোষণা করুন বাবা। আমার তো কোনও আপত্তি নেই। দেশের সেবা করার জন্য সিংহাসনে আসীন হতে হবে এমন কোনও বাধ্যবাধকতা নেই। আমি নাহয় নেপথ্যেই রইলাম।’
-’অজয় এখনও ছেলেমানুষ।’
উর্মিলা অস্থির ভাবে বললেন, ‘ছেলেমানুষ হবে কেন? দায়িত্ব কাঁধে পড়লে তবেই তো শিখবে, তাই না?’
তুর্যয় চট করে একবার তাকালো মায়ের দিকে। সে বুদ্ধিমান মানুষ। মায়ের কথার সুরটা ধরতে খুব একটা সমস্যা হল না। তবে অবাক না হয়েও পারল না। মা কি তাহলে তার চাইতে অজয়কেই সিংহাসনের জন্য বেশি উপযুক্ত ভাবছে? মহারাজ স্ত্রীর দিকে একবার চিন্তাযুক্ত নয়নে দৃকপাত করলেন। কিছু বললেন না। সমস্যা হলো তাঁর বড় পুত্র এবং মেজো পুত্র, দুজনেরই ক্ষমতার আসক্তি নেই। ক্ষমতা এদের কাছে কোনও গুরুত্বপূর্ণ বিষয় না। অজয়কে ক্রাউন প্রিন্স ঘোষণা করার কথা তুললে অজয় নিজেই এই প্রস্তাব অস্বীকার করবে। বড় ভাইয়ের উপস্থিতিতে সে কিছুতেই সিংহাসনে আসীন হতে চাইবে না। মহারাজ চিন্তিত কণ্ঠে বললেন, ‘কাল খুব সকালে দরবারে উপস্থিত হবে। তোমার জন্য একটা উপদেষ্টা কমিটি গঠন করা হয়েছে।’ এটুকু বলে ড্রয়ার থেকে একটি প্রিন্টেড কাগজ বের করে পুত্রের হাতে ধরিয়ে দিলেন তিনি। তুর্যয় বলল,
-’এই কমিটির কাজ কী হবে?’
-’তোমাকে রাজ্য পরিচালনার কাজে পারদর্শি করে তোলা।’
তুর্যয় একটু তাচ্ছিল্যের হাসি হেসে বলল, ‘আপনার মনে হয় এতে কাজ হবে?’
-কেন হবে না?’
তুর্যয় নাম গুলোর ওপর চোখ বুলিয়ে নিয়ে একটু সাবধানী গলায় মা'কে বলল, ‘আমার একজন শিক্ষিকা ছিলেন। তাঁকে কেন এই লিস্টে রাখা হয়নি?’
-'কার কথা বলছ?'
-'উনার নাম মেহেরু।'
উর্মিলা চোখ কপালে তুলে বললেন, ‘ওই মেয়ে হবে তোমার উপদেষ্টা? ও তো গ্র্যাজুয়েশনই কমপ্লিট করতে পারেনি। তোমার মাথা কি খারাপ হয়ে গেলো? এই তালিকায় রাজ্যের সব খ্যাতিমান বুদ্ধিজীবীদের নাম আছে। যারা বিভিন্ন সময়ে সরকারের নানা গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করে এসেছেন। '
তুর্যয় ভেতরে ভেতরে বেশ একটু বিব্রত বোধ করলেও, কন্ঠে স্বভাবসুলভ সপ্রতিভ ভাবটা বজায় রেখেই বলল, ‘গ্র্যাজুয়েশন করেননি তো কী হয়েছে? আমার জানা মতে তার নিজস্ব জ্ঞানের ভান্ডার সমৃদ্ধ। '
মহারাজ বুঝতে পারছেন না মাতা-পুত্র কার বিষয়ে কথা বলছে। ভ্রু কুঁচকে বললেন, ‘কে এই মেয়ে?’
উর্মিলার গলায় তাচ্ছিল্য ফুটে উঠল, ‘মাস্টারের মেয়ে। মাস্টার মারা যাবার পর পাঠশালার দায়ভার যাকে দেয়া হল। আপনি চিনবেন না। শোনো তুর্যয়, ওই মেয়েটির তোমার অফিসে যোগদান করার মতো কোন যোগ্যতা নেই। তার বাবা মারা যাবার পর তার পুরো পরিবার না খেতে পেয়ে মরে যাচ্ছিল। আমি নেহাত মায়ার বশে পাঠশালার চাকরিটা ওকে দিয়েছিলাম। এখন তো শুধু নীহারিকাকে পড়ায়। আর আমার ফাই ফরমায়েশ খাটে। ওর অবস্থান দাসি বাঁদিদের থেকে খুব একটা ওপরে নয়। মোটামুটি পড়াশোনা জানা আছে বলে আমার হয়ে ইমেইল টিমেইল টাইপ করে মাঝে মাঝে। এই মেয়ে তোমার অফিসে কী করবে?'
তুর্যয় মায়ের কথার সরাসরি কোনও উত্তর দিল না। তবে মেহেরুকে নিয়ে মায়ের জাজমেন্ট'টা পছন্দ হলো না তার। কাঠ কাঠ গলায় বলল, ‘আমার অফিসে পুরনো লয়্যাল লোকজন চাইছি। এতে ক্ষতি কী বুঝলাম না।' একটু থেমে হাতে ধরা কাগজটার দিকে ভ্রু কুঁচকে চেয়ে বলল, ‘আমার পি এস হিসেবে কাকে নিযুক্ত করেছেন? নামের জায়গাটা তো খালি।’
-’এখনও কাউকে নেয়া হয়নি। এটা এমন কোনও গুরুত্বপূর্ণ পদ নয়। বিশ্বস্ত কাউকে নিলেই হবে।’ মহারাজ বললেন।
তুর্যয়ের মুখে ঝকঝকে হাসিটা অনেক ক্ষণ পর ফিরে এলো, ‘বেশ তো, আমার ব্যক্তিগত সচিব হিসেবে তাহলে উনাকেই নিয়োগ দেয়া হোক।’
মহারানি চমকে উঠলেন, ‘কাকে?’
-’আমার শিক্ষিকা ছিলেন যিনি ...... এককালে।’
-'ওই মেয়ে হবে তোমার পিএস … কী আশ্চর্য!’ উর্মিলা যেন এতো আজব কথা কোনদিন শোনেননি।
-’সমস্যা কোথায়? এখন তো আর উনি আমার টিচার নন। রাজবাড়ির সাধারণ কর্মচারী। তাই না?’
-'কিন্তু মেয়েটা তো আমার কাজ করছে আপাতত। '
-'আপনার কাজের জন্য অন্য কাউকে নিযুক্ত করুন না মা! প্লিজ!'
তুর্যয়ের গলায় আকুতি ঝরে পড়ে। মহারাজ বিরক্ত মিশ্রিত কণ্ঠে স্ত্রীকে বললেন, ‘ওর যাকে পছন্দ নিক। তুমি এ নিয়ে আর তর্ক কোর না। এসব তুচ্ছ বিষয়ে আলোচনা করে সময় নষ্ট করার কোনও মানে হয় না।’
---------------------------------------
রাশিকা মনের আনন্দে নেচে বেড়াচ্ছিল। এই মুহূর্তে রাজভবনের সামনের চত্বরটা ফাঁকা। দূরে কয়েকজন প্রহরী দণ্ডায়মান। তাদেরকে রাশিকা খুব একটা পাত্তা দিচ্ছে না। তার এখন হেঁশেলখানায় ফিরে যাবার কথা। কিন্তু মন মতো নেচে গেয়ে আনন্দ প্রকাশ করার আগ পর্যন্ত কিছুতেই কাজে মন দিতে পারবে না। তাই ইচ্ছে মতো নেচে নিচ্ছে। ওর পরনে এখন কলার ওয়ালা লাল জামা। তার ওপর হলুদ অ্যাপ্রন। মাথার টুপিটা খুলে হাতে নিয়েছে সে। কানে লাগানো হেডফোনে কেটি পেরি’র গান বাজছে। বিকেল বেলার উচ্ছল রোদ ইচ্ছে মতো দাপিয়ে বেড়াচ্ছে সবুজ চত্বরে। ঘাসের ওপর ফুটে থাকা হলদে বুনো ফুল আর নীল নীহারিকায় দোল খাচ্ছে হাওয়া। মেঘেরা ভাসছে নিশ্চিন্তে। দূরে কোথাও ডাকছে একটা কোকিল। আর রাজবাড়ির ওই নচ্ছার লাল ঝুটি কাকাতুয়া এদিক সেদিক উড়ে বেড়াচ্ছে। তাকে এখনও খাঁচা বন্দি করতে পারেনি কেউ। গুলি না ছুঁড়লে একে ধরাশায়ী করা যাবে না। কিন্তু গুলি ছোড়াছুঁড়িতে রাজকন্যার নিষেধ আছে।
রাজপুত্র তার দিকে চেয়ে হেসেছে এই খুশিতে রাশিকা আত্মহারা। ফেসবুকে স্ট্যাটাসও দিয়ে ফেলেছে। তার মনে হচ্ছে সমুঞ্জকুঞ্জর এই সফর আজকের ওই এক টুকরো হাসির বদৌলতে সফল হয়ে উঠেছে। প্রাসাদ সম্মুখের রুপালি পিচঢালা রাস্তার ওপর গানের তালে তালে লাফিয়ে বেড়াচ্ছিল দুরন্ত অথচ বোকা মেয়েটা। আশেপাশের বাস্তব জগত থেকে সে বিচ্ছিন্ন। তার কানে কেটি পেরির জাদুকরী কণ্ঠ আর মনের চোখে এক রুপবান যুবকের ঝকঝকে প্রাণখোলা হাসি। সেই হাসি দেখলে যে কারো মন ভালো হয়ে যাবে। রাশিকা তার কল্পনার জগতে ক্রমেই ডুবে যাচ্ছিল। এমতাবস্থায়, আনন্দে ডোবা অর্ধনিমিলিত চোখের কিনার দিয়ে হঠাৎ একটি দৃশ্য অবলোকন করল সে। মাত্র কয়েক গজ দূরে মেঘের ধোঁয়াশার ভেতর থেকে যেন আচমকা প্রতীয়মান হয়ে উঠল তিনজন অশ্বারোহী। ঘোড়া গুলো এতো জোরে দৌড়চ্ছে যে আরেকটু হলেই বুঝি গায়ের ওপর উঠে আসবে। হৃদপিণ্ড ধক করে কণ্ঠনালীর কাছে উঠে এলো। কান থেকে হেডফোন খুলে নিল চট করে। খুলতেই অশ্বখুরের শব্দ বুকে এসে আঘাত হানতে লাগল। চোখ বিস্ফারিত। হাত পা অসাড়। বিলুপ্ত হয়ে গেছে চিন্তাশক্তি এবং চেতনাবোধ। মনে হচ্ছে এই ঘোড়ার খুরের আঘাতে যে কোনো মূহুর্তে পিষ্ট হবে সে।
যে ঘোড়াটা সামনে এগিয়ে ছিল, সে রাশিকার এক হাত দূরে এসে চিঁহিহি হ্রেষাধ্বনিতে ফেটে পড়ল। আকস্মিক হ্রাস টেনে ধরায় ঘোড়ার সামনের পা জোড়া তখন শূন্যে উঠে গেছে। খুরের দর্পিত আঘাত উড়িয়ে দিয়েছে পথের ধূলো। রাশিকা থরথর করে কাঁপছিল। এরা কারা? ডাকাত নয় তো? উদ্বেগ উত্তেজনায় চোখের দৃষ্টি ঝাপসা হয়ে আসছে। কিছুই যেন দেখতে পাচ্ছে না সামনে। চোখের পাতা বন্ধ।
কাঁপতে কাঁপতে টের পেলো অশ্বারোহী এখন তার চারপাশে প্রদক্ষিণ করছে। ঘোড়ার খুরের আওয়াজ এবং ক্ষীণ ডাক ভেসে আসছে কানে। সে কম্পিত আঁখি পল্লব উন্মোচন করল ধীরেধীরে। উড়ান মেঘের রোদ ঝকঝকে সাদা আস্তরের ভেতর দিয়ে দেখতে পেলো, ঘোড়ার পিঠে একজন যুবক বসে আছে। তার পরনে লাল রঙের প্রিন্স-কোট, সাদা প্যান্টালুন। হাঁটু পর্যন্ত লম্বা কালো বুট জুতো। কোটের পকেটে ঝুলছে সোনার চেইন। দেখলে মনে হয় সে বুঝি কোনও অচিন দেশের রাজপুত্র!
-------------------------
No comments