গল্প | উড়ান মেঘের দেশে - পর্ব-০৮ | Oran megher deshe - Part-08
লেখিকা | ওয়াসিকা নুযহাত
বিমানবন্দর সড়কে জনতার স্রোত নামলো বিকেল পাঁচটা নাগাদ। রাস্তার দুধারের ব্যারিকেডের ওপর উপচে পড়ছে মানুষ। সম্ভাব্য যুবরাজের নামে শত সহস্র কণ্ঠসমৃদ্ধ জয়ধ্বনিতে মুখরিত হচ্ছে বাতাস। কারো কারো হাতে আছে প্ল্যাকার্ড। প্ল্যাকার্ডে লেখা নানা রকম শুভেচ্ছা বার্তা। সাংবাদিকদের একটি বড়সড় দল বিমানবন্দর সদরে হুমড়ি খেয়ে পড়ছে। অরাজকতা নিয়ন্ত্রণ করার জন্য রাস্তায় নেমেছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। জনতাদের মধ্যে কেউ কেউ ঢোল তবলা বাজিয়ে আনন্দ প্রকাশ করছে। স্কুল কলেজের ছাত্র ছাত্রীরা দলবদ্ধ ভাবে ফ্ল্যাশমব করছে। সড়কের ধারঘেঁষা বহুতল ভবনের মাথায় তিনশত ইঞ্চির প্রশস্ত স্ক্রিনে আজ কোনও বিজ্ঞাপন নেই। বিজ্ঞাপনের বদলে এই মূল্যবান মুহূর্তটির সরাসরি লাইভ সম্প্রচার করা হচ্ছে। গোটা রাজ্যে বিরাজ করছে একটা উৎসবের আমেজ। ছয় কোটি জনতার মধ্যে যারা রাস্তায় নামেনি, তারাও ঘরে বসে খবর দেখছে, শুনছে। বড় রাজকুমারের এই প্রত্যাবর্তনের দিনটি যেন স্মরণীয় করে রাখতে চায় রাজ্যবাসী। যুবরাজ পদে তুর্যয়ের নাম ঘোষণার সম্ভাবনাই মূলত এই উত্তেজনার পেছনের মূল কারণ। দেশে অবস্থান না করলেও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের কল্যাণে এর মাঝেই তুর্যয় বেশ জনপ্রিয়। অন্যদিকে রাজ্যের তরুণ সম্প্রদায়ের ওপর মেজো কুমার অজয়ের প্রভাব খুব একটা ক্ষীণ নয়। এই অপামর জনতার একটি অংশ অজয়কেই সিংহাসনের উপযুক্ত বলে মনে করে। তবে এই দাবিকে নিছক ছেলেমানুষি আবদার বলে আখ্যায়িত করেছেন রাজ্যের পণ্ডিত ব্যক্তিবর্গ। তাদের বক্তব্য হলো উত্তরাধিকার আইন মোতাবেক বয়োজ্যেষ্ঠ সন্তানই সিংহাসনের দাবীদার। আজকের এই উল্লসিত জনতার ভিড়ে কে কোন কুমারের সমর্থক তা টের পাওয়া দুষ্কর। তবে কয়েকটি দল প্ল্যাকার্ডে অজয়ের নাম উল্লেখ করে বলেছে ভবিষ্যৎ শাসক হিসেবে তাদের তুর্যয়কে নয়, অজয়কেই চাই।
রাজপুত্রকে বরণ করার জন্য প্রাসাদ থেকে একটি কনভার্টিবল লিমোজিন গাড়ি এসেছে বিমানবন্দরে। তার পেছন পেছন রয়েছে মহারাজের ব্যক্তিগত সচিব ঘোষ মশাইয়ের গাড়ি এবং বেশ কয়েকটি টহলদার পুলিশের গাড়ি। তবে রাজকুমারের আগমন হবে মূলত ঘোড়ার পিঠে চড়ে। তাই গাড়ির পাশাপাশি শোভা পাচ্ছে সুসজ্জিত দুটি বিশাল আকৃতির হৃষ্টপুষ্ট ঘোড়া।
লিমোজিনের অভ্যন্তরে অপেক্ষারত অবস্থায় আছে ছোট রাজকুমার বিজয়, রাজকন্যা নীহারিকা এবং প্রধানমন্ত্রীর কন্যা রিয়া। মেজো কুমার অসুস্থতার বাহানায় বিমানবন্দরে আসেনি। ছোট কুমার এবং রিয়া গাড়ি থেকে সড়ক পথে অবতরণ করেছে। ব্যারিকেডের অপর প্রান্তে হুমড়ি খেয়ে পড়া জনতার সাথে হাত মিলাচ্ছে। কেউ কেউ সেলফি তোলায় ব্যস্ত হয়ে পড়েছে। প্রধানমন্ত্রীর মেয়ে হিসেবে রাজ্যে বেশ খ্যাতি আছে রিয়ার । তাছাড়া বড় রাজপুত্রর বাল্যকালের খেলার সঙ্গিনী হওয়ায় সাধারণ জনগণের কাছে তার ভাবমূর্তি অন্যরকম। আজকে তার পরনে রাজ্যের সবচেয়ে ব্যয়বহুল ডিজাইনারের ডিজাইন করা গাউন। তার চেহারা খানা এমনিতে ভারী চটকদার। বিলাসবহুল সাজপোশাকের কারণে আজ তাকে অন্যান্য দিনের তুলনায় আরো বেশি আকর্ষণীয় দেখাচ্ছে। রাজকন্যা নীহারিকার গাড়ির বাইরে পদার্পণ করা বারণ। সে লিমোজিনের কালো কাচের ভেতর থেকে চারপাশের গণ মানুষের কোলাহল প্রত্যক্ষ করছিল। আশ্চর্য ব্যাপার হল এই যে, তার চোখজোড়া এই সাধারণের ভিড়ের মাঝে বিশেষ একজনকে খুঁজে বেড়াচ্ছিল। অথচ সেই বিশেষ একজনের এখানে উপস্থিত হবার কোনও সম্ভাবনাই নেই। মেহেরু জানিয়েছে ইশানকে আজ ভোরবেলায় অক্ষত অবস্থায় মুক্তি দেয়া হয়েছে। নীহারিকা দুশ্চিন্তায় বিনিদ্র রাত্রি যাপন করেছিল। মুক্তির খবরটা জানার পর একটু স্বস্তির নিশ্বাস ফেলেছে। কিন্তু কী এক বিচিত্র কারণ বশত তার কেবলই মনে হচ্ছে ছেলেটার সাথে আর একবার অন্তত দেখা করাটা বাঞ্ছনীয়। দেখা হলে সে কী বলবে জানে না। কিন্তু কিছু একটা নিশ্চয়ই বলার আছে ...বলা উচিত …… নইলে বিনা কারণে তার মনটা ওরকম ওকে দেখার জন্য অমন আইটাই করবে কেন? কিন্তু ইশানকে খুব সম্ভবত রাজবাড়ির চৌহদ্দির ভেতরে আর কখনও দেখা যাবে না। নীহারিকা জানে, এতো ভয়ঙ্কর শাস্তির মুখ থেকে দৈবক্রমে মুক্তি পাবার পর ওই ছেলে কিছুতেই আর রাজবাড়ি মুখো হবার সাহস করবে না। এটা জানার পর, বুঝার পর থেকেই নীহারিকার বুকের ভেতর কেন যে অমন বিষণ্ণতার মেঘলা একটা আকাশ নেমে এসেছে কে জানে! তার আর কিছুই ভালো লাগছে না। ভাইদের মধ্যে তার সবচেয়ে প্রিয় হল তুর্যয়। প্রিয় ভাইটি আজ বহুদিন পর বাড়ি ফিরছে। কিন্তু এই আনন্দটুকু যেন তার আত্মাকে কিছুতেই ছুঁতে পারছে না। নিজেকে তার এই আড়ম্বরপূর্ণ মঞ্চে বড়ই অপাংক্তেয় বলে মনে হচ্ছে। এই বন্দি জীবন থেকে তার নিষ্কৃতি চাই। নিষ্কৃতির পথ একটাই। পথটির নাম মৃত্যু!
'#bangla_story_143' '#banglastory143'
সমুদ্রকুঞ্জের বড় কুমার তুর্যয় হংসমনি, রুপকথার রাজপুত্রদের মতোই রুপবান এবং তেজস্বী। তার চোখের রং কালো নয়, ধূসর। দেখলে মনে হয় ওই চোখের ভেতর আয়নার মতো জল চিকচিক করছে। আদতে ওটা জল নয়, বরং ধূসর চোখের নিশ্ছিদ্র গভীরতা।
টকটকে গৌরবর্ণের এই সুপুরুষ যুবকের পরিচয় গোপন করা হলেও, লোকে তাঁকে নির্দ্বিধায় রাজপুত্র হিসেবেই ধরে নেবে। অর্থাৎ সহজ বাংলায় ‘রাজপুত্রের মতো সুন্দর' বলতে যা বোঝায়, আমাদের বড় কুমার ঠিক তাই-ই!
কিন্তু রাজপুত্র হলেও তার দেহখানা আর দশটা সাধারণ মানুষের মতোই রক্ত মাংসে গড়া। এবং শরীরের ভেতরের যেই মন … সেই মনটা একেবারেই রাজার মতো রাজকীয়তায় ভরপুর নয়, বরং ফকির-দরবেশের মতো উদাসীনতায় টইটুম্বুর। আজকের এই আড়ম্বরপূর্ণ সংবর্ধনায় তার পদার্পণ হলো বড়ই অনাড়ম্বর ভাবে। তার পরনে একটা ছাই রঙের সস্তা টি শার্ট, নীল জিন্স। চোখে কালো রে-ব্যান। ফর্সা গালে হালকা চাপ-দাড়ি এবং কপালে বিরক্তিমাখা কয়েকটি সুদৃঢ় কুঞ্চন। সে বাবা মশাইকে বলেছিল আগমনের খবরটা যেন গোপন থাকে। তার ফিরে আসা উপলক্ষে অযথা স্কুল কলেজ বন্ধ করে একটা হাঙ্গামা বাঁধানোর কোনও মানে হয় না। ছুটির দিন হলে সমস্যা ছিল না। সপ্তাহের মাঝখানে গোটা দেশের মানুষ কাজকর্ম বন্ধ করে তাকে বরণ করে নেয়ার আয়োজনে মেতে উঠেছে, এই অতিরিক্ত আদিখ্যেতা তার মনের মধ্যে এক অদ্ভুত ধরণের অপরাধবোধের জন্ম দিচ্ছে।
তুর্যয়ের সাথে রয়েছে দুটি বড় আকারের স্যুটকেস এবং একটি ল্যাপটপের ব্যাকপ্যাক। স্যুটকেস দুটো ট্রলিতে চাপানো হয়েছে। ব্যাকপ্যাক কাঁধে। তুর্যয় নিজেই ট্রলি ঠেলছে। অথচ তার আশেপাশে জনা বিশেক লোক দাঁড়িয়ে আছে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেবার মহৎ অভিপ্রায় নিয়ে। তুর্যয় কিছুতেই এই সামান্য কাজের জন্য কারো সাহায্য নেবে না। সে বলেছে, আপনারা অস্থির হবেন না প্লিজ। আই ক্যান টেক কেয়ার অফ মাইসেলফ।
'#bangla_story_143' '#banglastory143'
-এতোদিন পর দেশে ফিরে এসে আপনার অনুভূতি কী?
-আপনি কি নিজেকে যুবরাজ হিসেবে যোগ্য মনে করছেন?
-আপনার চাইল্ডহুড ক্রাশ সম্পর্কে কিছু যদি বলতেন।
তুর্যয় এসব প্রশ্নের উত্তর দেবার প্রয়োজনীয়তা বোধ করছে না। তার চোখ গিয়ে ভিড়েছে সমুদ্রকুঞ্জের মনোরম নীল নির্জন আকাশে। সাদা মেঘের দল কুয়াশার মতো নেমে এসেছে রাজপথে। সেই মেঘের ওপর চিকচিক করে নেচে বেড়াচ্ছে রুপো রঙের সূর্য রশ্মি। তার মনটা আশ্চর্য রকমের প্রশান্তিতে ছেয়ে গেছে। এই প্রশান্তি শুধুমাত্র মাতৃভূমির সান্নিধ্যেই অর্জন করা সম্ভব। ভিড়ের মাঝে একজন লোক, (যাকে তুর্যয় চেনে না, হয়তো রাজসভার কোনও গুরুত্বপূর্ণ পদে আসীন এই ভদ্রলোক) কানের কাছে মুখ নামিয়ে বেশ জোর গলায় বলল, ‘মাননীয় রাজপুত্র, আপনি ব্যাগেজগুলো আমাদেরকে দিন। আমরা গাড়িতে তুলছি। আপনি অনুগ্রহ করে ঘোড়ার পিঠের আসন গ্রহণ করুন।’
জনতার বিরামহীন কোলাহলের কারণে লোকটার কণ্ঠস্বর ক্ষীণ হয়ে ধরা দিল তুর্যয়ের কানে। তবুও কথা গুলোর মর্মোদ্ধার করতে পেরেছে সে। অস্বস্তি নিয়ে বলছে, ‘এখন ঘোড়ায় চড়তে হবে?’
দায়িত্বপ্রাপ্ত লোকটি বেশ অবাক হলো এই প্রশ্ন শুনে -'জি হুজুর। শত বছর ধরে রাজপরিবারের এটাই ট্রেডিশন।'
তুর্যয় দৃঢ় কণ্ঠে বলল, ‘দুঃখিত। এই মুহূর্তে ঘোড়ায় উঠতে একেবারেই ইচ্ছে করছে না। প্লিজ আপনি গাড়ির ব্যাবস্থা করুন।’
লোকটি ইতস্তত করে বলল, ‘কিন্তু হুজুর, রাজপুত্রর আগমন ঘোড়ায় চড়ে না হলে …’
তুর্যয় থামিয়ে দিল লোকটাকে, ‘আমি জানি। নিয়ম ভঙ্গ হবে। হলে হোক। ঘোড়া নিয়ে প্রাসাদ পর্যন্ত যেতে কত সময় লাগবে বুঝতে পারছেন?’
-’ঘোড়ায় চড়ে আপনাকে শুধু কিছুটা পথ যেতে হবে। নিয়ম রক্ষার খাতিরে। প্রাসাদে পৌঁছনোর জন্য গাড়ির ব্যবস্থা করা আছে।’
তুর্যয় গম্ভীর ভাবে বলল, ‘আমি আমার সিদ্ধান্ত জানিয়ে দিয়েছি। এর নড়চড় হবে না।’
লিমোর সামনে রিয়া আর ছোট কুমার বিজয় অপেক্ষা করছিল। বিজয় ঝাঁপিয়ে পড়ে জড়িয়ে ধরল ভাইকে। তুর্যয় ওকে বুকের সাথে জাপটে ধরে বলল, ‘ ওরে গুল্টুশ , তুই তো আরো ফুলেছিস দেখি। কাহিনী কী?’ কথাটা বলে সে চারপাশে একবার নজর বুলিয়ে নিল, ‘অজয় কোথায়?’
-’মেজো ভাই-রাজার শরীর ভালো না।’
'#bangla_story_143' '#banglastory143'
জয়ধ্বনি চলছে বিরামহীন ভাবে। হৈ হট্টগোলে কোনও কথা ঠিক মতো কানে আসছে না। তুর্যয় রিয়ার সাথে হাত মেলানোর পালা শেষ করে লাফিয়ে উঠে বসল গাড়ির ভেতর। নীহারিকা প্রশস্ত গাড়ির কম্পার্টমেন্টের এক কোণে জড়োসড়ো হয়ে বসে ছিল। তুর্যয় ওকে দেখতে পেয়েই এক গাল হেসে বলল, ‘ কীরে আপু-রানি? তুই গাড়ির ভেতর লুকিয়ে আছিস কেন? আমি তো তোকেই খুঁজছিলাম সেই তখন থেকে!’ নীহারিকা ছুটে এসে ভাইকে জড়িয়ে ধরল। এক অনভিপ্রেত কান্নায় কণ্ঠরোধ হয়ে এলো তার। তুর্যয় কান্নারত বোনের দিকে অবাক চোখে চেয়ে প্রশ্ন করল, ‘কাঁদছিস কেন? কী হয়েছে?’
এই প্রশ্নের উত্তর নীহারিকা জানে না। শুধু জানে কিছু একটা হয়েছে তার। আর যা হয়েছে তা মোটেও ভালো কিছু নয়। কিন্তু মন বলছে বড় ভাই-রাজের উপস্থিতি সমস্ত অস্থিরতা হ্রাস করে দেবে। সে যেন অনেকদিন পর একটি নিরাপদ আশ্রয় পেয়েছে এমনই ভাবে ভাইকে জাপটে ধরে কাঁদতে লাগল। তুর্যয়ের মনটা খারাপ হয়ে গেলো বোনের কান্না দেখে। সেই মুহূর্তে সচিব ঘোষ মশাই গাড়ির খোলা দরজা দিয়ে মাথা এগিয়ে দিয়ে বললেন, ‘মাননীয় রাজপুত্র, আপনি গাড়ির ছাদ খুলে উঠে দাঁড়ান। জনগণ আপনাকে দেখতে চায়।’
কথাটা পুরোপুরি শেষ হতে না হতেই লিমোজিনের ছাদ খুলে গেলো। বসা থেকে উঠে দাঁড়ালো রাজপুত্র। পাশে রিয়াও আছে। তুর্যয় দেখল নীহারিকা গুটিসুটি ভাবে আড়াল হয়ে বসে আছে একপাশে।
-'তুই বসে আছিস কেন আপু-রানি? উঠে দাঁড়া। '
নীহারিকা শঙ্কিত গলায় বলে, ‘না ভাই-রাজা। আমার নিষেধ আছে।’
-’মানে কী?’
-’মা রাগ করবেন। '
তুর্যয় অভয় দিয়ে বলে, ‘আমি আছি না? তোর ভয় কীসের? মা'কে আমি বুঝিয়ে বলব। '
নীহারিকার বুকটা দুরদুরু করে। বড় হবার থেকে কোনদিন সে জনসম্মুখে যায়নি। রাজপথে কখনও গাড়ির জানালা দিয়ে মুখ বের করেনি। চলন্ত গাড়ির দুরন্ত বাতাসের ঝাপটা তার মুখে লাগে না বহুদিন! কালো রঙের কাচ ঘেরা বাহনের ভেতরে বন্দি হয়ে থেকেই সর্বদা যাতায়াত করে। বহুদিন হয় কোনও শপিং মলে যাওয়া হয় না। তার সমস্ত পোশাক অনলাইনে অর্ডার দেয়া হয়। নইলে রাজবাড়িতেই গোটা বাজারটা তুলে নিয়ে আসা হয় তার জন্য। সে প্রাসাদের অভ্যন্তরে অবস্থান করেই জিনিসপত্র ক্রয় করে। আজকে তুর্জয়ের কথামতো জনতার সামনে মাথা তুলে দাঁড়ালে, এর পরিণতি কী হবে? ভাবতেই শঙ্কার এক সূচালো তীর তার বুকের মধ্যে বিঁধতে লাগল। ঠিকমতো কিছু ভেবে উঠতে পারল না, তুর্যয় ওর হাত টেনে ধরে নিজের পাশে দাঁড় করিয়ে দিল। লোকে নিহারীকাকে ঠিকঠাক চেনে না। রাজপুত্রের পাশে অচেনা রুপবতী মেয়েটিকে দেখে জনতার উদ্দীপনা বৃদ্ধি পেলো। অনেকে সাজপোশাক দেখে ঠাওর করতে পারল 'ইহাই রাজকন্যা। '
নীহারিকা আড়ষ্টতায় জাড় হয়ে গেলো একদম। ভাই-রাজার হাত জড়িয়ে ধরে অবনত মুখে দাঁড়িয়ে রইল। কালো রঙের লিমো রাজপথ ধরে এগিয়ে যাচ্ছিল ধীরেধীরে। দুধারে জনগণের চিৎকার, উল্লাস আর কোলাহল। তুর্যয় ক্রমাগত হাত নেড়ে যাচ্ছিল উপস্থিত জনতার উদ্দেশ্যে। শত শত ক্যামেরায় ক্লিক পড়ছিল অবিরাম।
---------
রাজবাড়ির সিংহদ্বার নানারকম বাতি দ্বারা সজ্জিত। বিশাল বড় এক ব্যান্ড দল কোট-প্যান্ট, বুট জুতো আর মাথায় টুপি পরে অনেকক্ষণ যাবত বাজনা বাজিয়ে চলেছে। মূল রাজভবনের সামনে কর্মচারীদের একটি বড়সড় দল সারি বেঁধে দাঁড়িয়ে আছে। এদের কারো হাতে মালা, কারো হাতে কাঁচা ফুলের পাপড়ি। মূল রাজভবন সংলগ্ন সুবিশাল দেউড়িতে দাঁড়িয়ে আছেন স্বয়ং মহারানি উর্মিলা। রাজপুত্রকে চন্দনের টিপ পরিয়ে বরণ করা হবে। সেই সাথে সমস্বরে সকলে উলুধ্বনি দেবে। রানিমার পাশে রুপোর রেকাবিতে চন্দন নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে একজন দাসি। রাশিকার এখানে কোনও কাজ নেই তবুও সে বাবুর্চির পোশাক পরেই ভিড়ের মধ্যে দাঁড়িয়ে গেছে। আপাতত রাজকুমারকে এক ঝলক দেখতে পেলেই তার আশা পূরণ হবে। আর কিছু চাই না।
মেহেরু রানিমার নিকটেই দাঁড়িয়ে ছিল। তার পরনে একটা বেগুনি রঙের সুতি শাড়ি। ফুলহাত ব্লাউজ। মুখে কোনও প্রসাধন নেই। ঘাড়ের ওপর একটা হাত খোঁপা করা। সাজগোজ সে কখনওই করে না। করার প্রয়োজনও পড়ে না। প্রকৃতি প্রদত্ত সৌন্দর্যের এক আবাধ্য অত্যাচারে তার মুখখানা সর্বদা মাখামাখি হয়ে থাকে। তবে এই মুহূর্তে নিজের সাজসজ্জা নিয়ে সে কিঞ্চিৎ বিব্রত। কারণ একটু আগে রাশিকা তাকে ভিড়ের মধ্যে ফট করে বলে বসেছে, ‘আপা, আজকে একটা এত বড় প্রোগ্রাম। আপনি সাজবেন না একটু? আমার যদি এখন ডিউটি না থাকত রান্নাঘরে, তাহলে দেখতেন মাঞ্জা মাইরা ফাটায় দিতাম।’
মেহেরু অপ্রস্তুত হেসে বলেছে ' কেন খারাপ দেখাচ্ছে?'
-'আপনাকে খারাপ দেখাবে? মাথা নষ্ট? তবে একটু সাজলে ভাল হত। সবাই তো সেজেছে। বাই চান্স যদি টিভিতে দেখায় সেই লোভে।'
মেহেরুর টিভিতে নিজেকে প্রদর্শন করার কোনো ইচ্ছে নেই। তবে রাশিকার কথাটা শোনার পর থেকেই একটা খুঁতখুঁতে ভাবের উদয় হয়েছে। অথচ সাজগোজ করার মতো মনটা হারিয়ে গেছে বহু আগে। আজকাল তার মধ্যে একটা বয়সোচিত গাম্ভীর্যও এসে গেছে। কদিন আগে রাজকন্যার জন্মদিনে সেজেছিল একটু। ঠোঁটে লিপস্টিক,চোখে কাজল। তাই দেখে দাসি শঙ্খবালা মুখ বাঁকিয়ে বলেছে, ‘আইবুড়ো মাগির ঢং দেখো! বিয়ে তো করবে না, শুধু রুপ প্রদর্শন করে বেড়াবে। নষ্ট মেয়েমানুষ।’
'#bangla_story_143' '#banglastory143'
বলতে নেই শঙ্খবালার স্বামীর একটু ছোঁকছোঁক স্বভাব আছে। একদিন নির্জনে সুযোগ বুঝে সে মেহেরুর কোমর জড়িয়ে ধরেছিল। শঙ্খবালার কাছে নালিশ করতেই সে উল্টো মেহেরুর কাঁধে দোষ চাপালো। এরপর থেকে একরকম উঠে পড়ে লেগেছে সে মেহেরুর পিছে। কোনদিন যে রানিমার কাছে উল্টো পাল্টা মিথ্যে নিন্দা করে বসে সেই ভয়েই মেহেরুর ভেতরটা গাঁট হয়ে থাকে আজকাল।
মেহেরু জীবনে কখনও কোনও পুরুষের সাথে ছলনা করেনি, কারো অবৈধ শয্যাসঙ্গিনীও হয়নি। তার একটাই দোষ। দোষটা হলো এখনও সে অবিবাহিতা। সেদিন স্কুলের এক বান্ধবীর সাথে বহুদিন পর দেখা। গল্পের মাঝখানে বান্ধবী হঠাৎ খুব বিশ্রী ভাবে বলে উঠল,
-’বিয়ে থা করিস না কেন?’
-’ইচ্ছে নেই।’
-’কেন? লোকে তোর নামে কী কী বলে বেড়ায় জানিস?’
-’কী বলে?’
-’জানিস না বুঝি?’
-জানি না তো!’ মেহেরু বোকা সাজার ভাণ ধরে।
-’লোকে বলে মহারাজের নির্দেশে তুই এখনো বিয়ে করিসনি। তুই মহারাজের গোপন রক্ষিতা। '
মেহেরু রাগটা হজম করে। ঠান্ডা গলায় বলে ‘এসব বাজে কথায় কান দিস কেন?’
-'কান দেই না ভাই। কানে এমনিতেই আসে। তোর বদনামের দুর্গন্ধে টিকে থাকা দায় হয়ে গেছে। তাড়াতাড়ি একটা বিয়ে কর। এদিকে আমাদের বাচ্চা কাচ্চাও হয়ে গেলো। তোর রুপ তো দিনদিন বেড়ে যাচ্ছে নির্লজ্জর মতো। রাজবাড়ির সভা সমিতির কাউকে ধরে ফ্যাল। বসে আছিস কেন?'
মেহেরু কোনও উত্তর দিল না। চুপচাপ কফির মগে চুমুক দিতে লাগল। বিয়ের প্রস্তাব যে আসে না তা নয়। প্রায়ই আসে। তার মায়েরও এই নিয়ে দুশ্চিন্তার শেষ নেই। কিন্তু কী করবে সে? কাকে বলবে ... কীভাবে বলবে .... যে তার জীবনে কখনওই বিয়ে করা সম্ভব হবে না। সে তো আর দশটা সাধারণ মানুষের মতো নয়। জাদুশক্তি তার জীবনে যেমন আশির্বাদ হয়ে এসেছে, ঠিক তেমনি এই শক্তিই তার জীবনের একমাত্র অভিশাপ। কথায় আছে ‘এভ্রি ম্যাজিক কামস উইদ আ প্রাইজ।’
গেটের সামনে হট্টগোল শুরু হয়েছে। সাংবাদিকদের ভিড় জমে গেছে। ব্যান্ডের বাজনা বেজে চলেছে অনবরত। বড় রাজকুমার নিশ্চয়ই পৌঁছে গেছে প্রাসাদ প্রাঙ্গণে। মেহেরুর বুকটা হঠাৎ বিনা কারণেই কেমন খালি খালি লাগতে লাগল। কীসের যেন শুন্যতা .... নাকি উত্তেজনা?
আচ্ছা তুর্যয়ের কি মনে আছে? মনে থাকার কি কথা ছিল? নাহ ....রাজকীয়দের তুচ্ছ বিষয় মনে রাখার নিয়ম নেই! তুর্যয় হয়ত মেহেরুর চেহারাই ভুলে গেছে। ভুলে যাওয়াটাই স্বাভাবিক!
.........................................
No comments