গল্প | উড়ান মেঘের দেশে - পর্ব-০১ | Oran megher - Part-01
লেখিকা | ওয়াসিকা নুযহাত
সে অনেক কাল আগের কথা নয়। মাত্র পাঁচশত বছর পূর্বে একজন রাজবংশোদ্ভূত হিন্দু ব্রাহ্মণ এবং তার স্ত্রী কোন এক নিগুঢ় কারণ বশত নিজ রাজ্য থেকে বিতাড়িত হয়ে দূর সমুদ্রে অজানার উদ্দেশ্যে পাড়ি জমিয়েছিল। কথিত আছে বিরতিহীন যাত্রার এক পর্যায়ে তারা খাদ্যহীন অবস্থায় মৃত্যুর প্রায় দ্বারপ্রান্তে পৌঁছে গিয়েছিল। এমতাবস্থায় সমুদ্রে উঠেছিল প্রলয়ঙ্করী রাক্ষুসে ঝড়। কৃষ্ণাভ মেঘের দল তাদেরকে চারপাশ থেকে ঘিরে ফেলেছিল কালো জাদুর ন্যায়। ফেনিল ঢেউ ডাইনোসারের হা করা মুখের মতো তেড়ে এসে গ্রাস করতে চাইছিল নড়বরে ছোট্ট তরি। শেষতক সেই অসহায় দম্পতির সহায় হলেন ঈশ্বর। হঠাৎ যেন মেঘ এবং সমুদ্রের জলরাশি ফুঁড়ে একটি জনমানবহীন ভূখণ্ডর উদয় হলো। ব্রাহ্মণ দম্পতি জীবন বাঁচাতে সেই ভূখণ্ডে আশ্রয় নিল। জায়গাটা বঙ্গোপসাগরের পূর্বদিকে আন্দামান দ্বীপের কাছাকছি মায়ানমার সাগরের দক্ষিণ পশ্চিম সীমানায়। ব্রাহ্মণ এবং তার স্ত্রী ফলমূল ভক্ষণ করে জীবন রক্ষা করল। শুরু করল জীবন যাপন। একসময় সন্তানের আবির্ভাব হল। ধীরেধীরে জনমানবহীন প্রান্তর মানুষের পদচারনায় মুখর হয়ে উঠল। স্থানটির নাম রাখা হল সমুদ্রকুঞ্জ।
সমুদ্রকুঞ্জের ইতিহাস পাঁচশত বছরের পুরনো। গত পাঁচ শতাব্দীতে এই দেশে একাধিক শাসকের উথান এবং পতন হয়েছে। তবে আমরা এখন সেই ইতিহাস ঘাঁটতে যাব না। আমাদের গল্পটির সূচনা হয়েছে দু হাজার উনিশ সালের পয়লা ফাল্গুনের মেঘাচ্ছন্ন ভোরবেলায়। যখন মহারাজ বীরবল হংসমণির দুরারোগ্য এক ব্যাধি ধরা পড়ল এবং একই সময়ে একজন মাঝবয়সি পাগল রমণী সমুদ্রের তীর থেকে সুউচ্চ পাহাড়ের ওপর অবস্থিত রাজদূর্গ পর্যন্ত যে পাহাড়ি পথটি সাপের মতো এঁকেবেকে উঠে গেছে অনেক উঁচুতে সেই পথ ধরে দৌড়তে দৌড়তে চিৎকার করে বলতে লাগল ‘হুশিয়ার সবাইকে! অভিশাপ বাস্তবায়িত হওয়ার সময় এসে গেছে! হুশিয়ার!’
সমূদ্রের তীরে দাঁড়িয়ে উঁচুতে তাকালেই পাহাড়ের চূড়ায় দণ্ডায়মান প্রাসাদের তিনটি সুউচ্চ গম্বুজ চোখে পড়ে। গম্বুজের চূড়ায় রয়েছে সুচ্যগ্র চূড়াদন্ড। প্রায় তিন একর জমির ওপর গড়ে ওঠা এই প্রাসাদটি মূলত একটি রাজভবন এবং চারটি মহলের সমন্বয়ে গঠিত। মহলগুলোর স্থাপত্যশৈলীতে মোঘল ও ইউরোপীয় প্রথাসিদ্ধতার সংমিশ্রন ঘটেছে। প্রতিটি মহলের সাথে রয়েছে নয়নাভিরাম বাগিচা এবং স্বচ্ছ জলের মনোরম পুষ্করিণী।
এই মূহুর্তে আমরা পটভূমিকায় দেখতে পাচ্ছি মহারাজের সুপ্রশস্ত কক্ষ। রাজ্যের প্রধান চিকিৎসক ক্ষণকাল আগে প্রস্থান করেছেন কক্ষ থেকে। ভোরের নরম আলো প্রাসাদের বাতায়ন পার হয়ে চুপিসারে এসে শুয়েছে মার্বেল পাথর খচিত চকচকে মেঝের ওপর। শত বৎসরের পুরোনো ঘুলঘুলির ফাঁক গলে সূর্য রশ্মির সোনালি সরল রেখা রাজকক্ষের বাইশ ফিট উঁচু সিলিং এবং চল্লিশ সে:মি: চওড়া মোটা বীম ছুঁয়ে দিয়েছে। দুই সিঁড়ির ধাপ ওয়ালা উঁচু খাটে মহারাজ বীরবল হংসমনি শায়িত আছেন। গায়ের ওপর কাশ্মিরি নকশা খচিত দামি কম্বল। তাঁর ঠিক পাশেই ক্রন্দনরত অবস্থায় দাঁড়িয়ে আছেন রাজ্যের পাটরানি উর্মিলা। অনতিদূরে কয়েকজন দাসি উপস্থিত আছে। মহারাজের চক্ষুদ্বয় মুদিত। পুরু গোঁফের নিচের ওষ্ঠের ভাঁজে কিঞ্চিৎ অসহিষ্ণুতা। তিনি মহারানীকে ইশারায় নিজের কাছ ডেকে ক্ষীণ কণ্ঠে বললেন, ‘বড় রাজপুত্রকে খবর দাও। খুব শীঘ্র তাকে ফিরে আসতে বলো।’
#ওয়াসিক_নুযহাত, #wasika_nuzhat_faria
আদেশ শুনে মহারানির পানপাতার মতো লম্বাটে মায়াবী মুখখানায় হালকা একটা দুশ্চিন্তার রেখা পড়ল। তিনি অত্যন্ত বিনয়ের সাথে বললেন, ‘মহারাজ! রাজপুত্রের পড়া এখনও শেষ হয়নি। আরও বছর খানেক সময় লাগবে। তার শিক্ষার ব্যাঘাত ঘটানো কি উচিৎ কাজ হবে?’
মহারাজ এই পর্যায়ে বিরক্ত হলেন। কঠিন স্বরে বললেন, ‘অনেক শিক্ষা লাভ হয়েছে। এখন রাজ্য সামলাতে হবে। আমার যাবার সময় হয়ে গেছে।’
মহারাজ বীরবল হংসমনি লম্বা চওড়া আকৃতির শ্যামবর্ণের বলিষ্ঠ পুরুষ। বয়সে প্রৌঢ় হলেও তাঁর প্রাণশক্তি ছিল অফুরন্ত। তিনি নিয়মমাফিক শরীর চর্চা করতেন। অশ্বচালনা, বন্দুক চালনা এবং কুস্তি লড়ার মতো যুবকোচিত কাজে তাঁর উৎসাহের কমতি ছিল না। দিন কতক আগেও তিনি মেজো এবং ছোট রাজকুমারকে সঙ্গে নিয়ে অশ্বচালনা করে মৃগয়ায় গেছেন। রাজ্যের দরিদ্র প্রজাদের প্রতি তাঁর দৃষ্টিভঙ্গি অত্যন্ত উদার। তাঁর শাসনকালে এই রাজ্যে কেউ কোনদিন এক বেলাও অভুক্ত থাকেনি। এখানে শতকরা সত্তর ভাগ জনগণ শিক্ষিত। জ্ঞান বিজ্ঞান এবং প্রযুক্তিতে সমুদ্রকুঞ্জ পিছিয়ে নেই। যুগের সাথে তাল মিলিয়ে এগিয়ে চলেছে। মহারাজের শুধু একটিই বদ অভ্যাস আছে। তিনি অন্যায় সহ্য করতে পারেন না। তাঁর সম্রাজ্যে নিয়মভঙ্গের শাস্তি মাত্রই মৃত্যুদণ্ড। চরিত্রের এই নিষ্ঠুরতা সত্ত্বেও রাজ্যের সাধারণ জনগণ তাঁকে ভালোবাসে। সুস্বাস্থ্যর অধিকারী দোর্দণ্ড প্রতাপ শাসকের এই আকস্মিক রোগাক্রান্ত হয়ে পড়াটা অনেকের কাছেই অবিশ্বাস্য বলে ঠেকছে। সকাল হবার সঙ্গে সঙ্গেই দলে দলে সাংবাদিকরা ভিড় জমিয়েছে রাজ দরবারে। তাদেরকে প্রাসাদের সিংহদ্বার অর্থাৎ প্রধান ফটকের বাইরেই দাঁড় করিয়ে রাখা হয়েছে। অভ্যন্তরে ঢুকতে দেয়া হচ্ছে না। রাজ পরিবারের কোন সদস্যের মুখোমুখি এখনও হতে পারেনি এই সংবাদিকের দল। খবরের চ্যানেল গুলোতে এর মাঝেই মহারাজের অসুস্থতার খবর সম্প্রচার করা হয়ে গেছে। রাজ্যে নেমে এসেছে কালো শোকের ছায়া। এরকম থমথমে বিষণ্ণ একটা দিনকে আরও বেশি ভয়াবহ করে তুলল জঙ্গলে বসবাসরত উন্মাদিনীর হুঁশিয়ারি বার্তা। এই মাঝবয়সি উন্মাদ রমণীটি দীর্ঘকাল যাবত সমুদ্রের তীরবর্তী অরণ্যে উদ্দেশ্যহীন ভাবে ঘুরে বেড়ায়। এর জীবনের ইতিহাস কেউ জানে না। কেউ কোনদিন তাকে কারো সাথে কথা বলতে দেখেনি। এই মানুষী কী খেয়ে বেঁচে থাকে, কোথায় রাত্রি যাপন করে সেই সমাচার সকলের অজানা। অনেকে তাকে ডাইনি বলে। বাচ্চারা দুষ্টুমি করলে জঙ্গলের ডাইনি এসে ঘাড় মটকে দেবে বলে ভয় দেখানো হয়। পাহাড়ের ওপরে, নগরীর সভ্য জনগণ যেখানে বসবাস করে, স্মরণকালেও সেখানে এই উন্মাদিনীর পদচারণ ঘটেনি। পয়লা ফাল্গুনের ভোরবেলায়, প্রথমবারের মতো এই পাগল রমণীর পায়ের ছাপ পড়ল সমুদ্রকুঞ্জের রাজধানিতে। তার পরনে একটি ময়লা শাড়ি। এতো ময়লা যে শাড়ির রং চেনা যায় না। পায়ের গোড়ালি পর্যন্ত সাদা চুল। কালো কর্দমাক্ত মুখে জ্বলজ্বল করছে হিংস্র জন্তুর মতো দুটি চোখ। পাহাড়ের মাঝামাঝি অবস্থানে শহরতলি। আরও কয়েকশ ফিট উঁচুতে একেবারে সুউচ্চ চূড়োয় অবস্থিত রাজপ্রাসাদ। উন্মাদ রমণী চিৎকার করতে করতে প্রাসাদের দিকেই অগ্রসর হচ্ছিল। পথিমধ্যে তাকে আটকে দিল পুলিশের গাড়ি। জেলখানায় বন্দি অবস্থায়ও সে একটি মাত্র বাক্য প্রলাপ বকার মতো বারংবার আওড়াতে থাকল, অভিশাপ! অভিশাপ! এবার অভিশাপ থেকে কেউ বাঁচবে না!
#উড়ান_মেঘের_দেশে, #oran_megher_deshe
#ওয়াসিক_নুযহাত, #wasika_nuzhat_faria
পাটরানি উর্মিলা মহারাজকে কুর্নিশ করে তাঁর কক্ষ থেকে বিদায় নিলেন। এই মুহূর্তে তিনি প্রাসাদ সংলগ্ন সুদীর্ঘ অলিন্দ পার হচ্ছেন। অলিন্দটি পরিখার মতো পুরো মূল রাজভবনকে ঘিরে রেখেছে। রেলিঙে জড়ানো আছে সবুজ গুল্মলতা। নিচতলার সভাকক্ষে উপস্থিত হয়েছেন মন্ত্রীগণ। মহারাজ অসুস্থতার কারণে সভায় উপস্থিত থাকতে পারছেন না। তাঁর পরিবর্তে রানিকে উপস্থিত থাকতে হবে। রানিমার পেছনে পাঁচ ছয় সদস্য বিশিষ্ট মেয়েদের একটি দল। এই মেয়েরা তাঁর নিজস্ব দাসি। রানির পরনে একটি সাদা জমিন সোনালি পাড়ের সুতোর কাজ করা সিল্কের শাড়ি। ফুলহাত ব্লাউজ। গলায় হীরের পাথর খচিত স্বর্ণের হার। চুলের খোঁপায় স্বর্ণের কাঁটা। তার মুখমন্ডল এই মুহূর্তে প্রসাধন রহিত। রাজবাড়ির রানি এবং রাজকন্যাদের সাজগোজ ছাড়া এক মুহূর্তও থাকার নিয়ম নেই। কিন্তু আজকের দিনটি ব্যতিক্রম। আজ রানিমার মন অত্যধিক খারাপ। সাজগোজ করার মতো বিন্দুমাত্র মানসিকতা তাঁর নেই।
দাসিদের পরনে নীল রঙের সুতির শাড়ি। সকলের শাড়ির বরণ এবং পরার ধরণ একই রকম। যে মেয়েটি রানির একেবারে পাশ ঘেঁষে হাঁটছে তার নাম মেহেরু। এই রমণীর পোশাকের রং ভিন্ন। হাঁটার ধরণ দেখেও বোঝা যায় রাজবাড়িতে তার অবস্থান দাসিদের চেয়ে কিঞ্চিৎ ওপরে। তার সাজ পোশাক জাঁকজমক নয়, তবে পরিশীলিত। সে পরেছে জলাপাই রঙের সুতির শাড়ি। তার চেহারা গ্রিক দেবি হেকেটির মতো কাটা কাটা, নিখুঁত। চোখ দুটি হরিণের মতো টানা। গায়ের রং উজ্জ্বল। বয়স তিরিশ। কোনও এক অজ্ঞাত কারণে এখন পর্যন্ত অবিবাহিতা। বর্তমানে সে রাজকন্যা নিহারীকার গৃহশিক্ষিকা এবং পাটরানির ব্যক্তিগত সহকারির দায়িত্ব পালন করছে। রানিমা হাঁটতে হাঁটতে আদেশ দিলেন, ‘মেহেরু, এখুনি বড় রাজকুমারকে ইমেইল করো। তাকে মহারাজের শারীরিক অবস্থা সম্পর্কে জানাও। দ্রুত দেশে ফিরে আসতে বলো।’
মেহেরু ‘জো হুকুম রানিমা’ বলে থামল একবার। তারপর বলল, ‘আমাকে তাহলে অফিস রুমে যেতে হবে। আমার মোবাইলে এই মুহূর্তে ইন্টারনেট কানেকশন নেই।’
#উড়ান_মেঘের_দেশে, #oran_megher_deshe
#ওয়াসিক_নুযহাত, #wasika_nuzhat_faria
-’কেন নেই?’
মেহেরু একটু একটু আমতা আমতা করল, ‘কারণটা সঠিক জানি না। আজ সকাল থেকে ইন্টারনেট সংযোগ খুব দুর্বল। '
রানিমা অধৈর্য কণ্ঠে বললেন, ‘যা করার তাড়াতাড়ি করো। রাজপুত্রকে বলো আজ কালের মধ্যেই সমুদ্রকুঞ্জে উপস্থিত হতে।’
এখানে উল্লেখ্য যে সমুদ্রকুঞ্জের বড় রাজপুত্র তুর্যয় হংসমনি বিগত বেশ কয়েক বছর যাবত দেশের বাইরে অবস্থান করছেন। বর্তমানে তিনি যুক্তরাজ্যর ক্যামব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ে উচ্চতর শিক্ষা অর্জনে নিয়োজিত আছেন। তার বয়স পঁচিশ। মেধাবি ছাত্র। আমাদের মেজো রাজকুমার অজয় হংসমনি তাঁর বড় ভাইয়ের সম্পূর্ণ বিপরীত। পড়াশোনায় মন নেই। হাই স্কুল পাশ করেই শিক্ষা জীবনের ইতি টেনেছেন। তাঁর বয়স তেইশ। খেলাধুলায় প্রবল আগ্রহ। খেলাধুলার পরপর তার জীবনের দ্বিতীয় আগ্রহের ক্ষেত্র হল নারী। তার বান্ধবীদের পেছনে ইদানিং রাজকোষের বিপুল অর্থ ব্যয় হচ্ছে। ছোট রাজকুমার বিজয় হংসমনি এবার ষোলতে পড়ল। তিনি খেতে ভালোবাসেন। রাজবাড়ির রন্ধনশালায় এই একজন সদস্যের জন্যই নিত্যদিন নানা উপাদেয় দেশি বেদেশি খাবারের আয়োজন করা হয়। বেশি খেতে খেতে রাজকুমার বিজয় অতিরিক্ত ওজনের অধিকারী হয়ে উঠেছেন। ডাক্তার বলেছে তার জন্য ওজন কমানো এখন বাঞ্ছনীয়। কিন্তু ছোট রাজকুমারের ভোজন প্রীতি উপশমের কোনও লক্ষণ নেই। বরং দিনকে দিন আরও বেড়েই চলেছে। রাজ্যের রাজকন্যা নিহারীকা হংসমনির বয়স আঠার। এই বছর তাঁর কলেজে অ্যাডমিশন হয়েছে।
রানিমার দপ্তরখানাটি মূল রাজভবন সংলগ্ন ল্যাভেন্ডার বাগানের শেষ অংশে অবস্থিত। দুই কক্ষ বিশিষ্ট ক্ষুদ্র ভবনের পাশ ঘেঁষে পাহাড়টা থাকে থাকে ঢালু হয়ে নেমে গেছে অনেক নিচে। সমুদ্রের একেবারে পার বরাবর। বাতায়নে দাঁড়ালে পাহাড়ের পাদদেশে বয়ে চলা নীল সমুদ্র দেখা যায়। আর দেখা যায় পাহাড়ের খাঁজে গড়ে ওঠা ছবির মতো সুন্দর শহর সমুদ্রকুঞ্জ। ঝকঝকে রাস্তাঘাট, ভিক্টোরিয়ান যুগের আদলে গড়ে ওঠা অফিস আদালত, স্কুল কলেজ, বসত বাড়ি। নগরের ওপর দিয়ে শঙ্খচিলের মতো সাদা রঙের উড়ান মেঘেরা ঘুরে বেড়ায়। মাঝে মাঝে মেঘের ঘনঘটায় শহরটা অদৃশ্য হয়ে ওঠে। বাতায়নে চোখ রেখে মেহেরু তখন শুধু কুয়াশার মতো মেঘ দেখে। আর কিছুই দেখতে পায় না। এই মেঘেদের সাথে মেহেরুর একটা আলাদা রকমের মজার সম্পর্ক আছে।এই সম্পর্কর কথা স্বয়ং রানিমাও জানেন না। জানানোর সাহস কখনও হয়ে ওঠেনি।
#উড়ান_মেঘের_দেশে, #oran_megher_deshe
#ওয়াসিক_নুযহাত, #wasika_nuzhat_faria
আজকে দপ্তরখানায় একটু বিচলিত ভাবেই পা রাখল মেহেরু। বড় রাজকুমার তুর্যয়ের সাথে তার শেষবার সাক্ষাত হয়েছিল অনেক বছর আগে। তুর্যয় তখন বয়সে নিতান্তই বালক। মেহেরু দুই রাজপুত্র এবং রাজকন্যার গৃহ শিক্ষিকার দায়িত্ব পালন করে আসছে বহুদিন হলো। সপ্তাহে তিনদিন ওদেরকে গণিত পড়াত সে। অল্পবয়সী রাজকুমার রাজকন্যাকে বকা ঝকা করতেও বাঁধত না সে সময়। মনে আছে একবার অংকের খাতায় কবিতা লিখেছিল বলে বড় রাজকুমারের কান মলে দিয়েছিল মেহেরু। কান মলা খেয়ে রাজকুমার তার ডাগর দুটি চক্ষু কঠোর করে বলেছিল, ‘রাজপুত্রের গায়ে হাত তুললে? মহারাজকে বলে দিব কিন্তু!’
মেহেরুও দমবার পাত্রী ছিল না, ধমকে উঠে বলেছে, ‘বলেই দ্যাখো না, আমিও মহারাজের কাছে নালিশ দিব যে তোমার পড়াশোনায় মন নেই।’
সেই ছোট্ট রাজার কুমার আজ কত বড় হয়ে গেছে। বিশ্বের নামকরা বিশ্ববিদ্যালয়য়ে পি এইচ ডি করছে। আর মেহেরু এখনও রাজবাড়ির চার দেয়ালের মধ্যেই বন্দি হয়ে আছে। বয়স বেড়ে গেছে, চেহারা পাল্টে গেছে কিন্তু জীবনটা পাল্টায়নি একটা বিন্দুও। উচ্চশিক্ষা লাভ করার ইচ্ছে ছিল। কিন্তু রানিমার সম্মতি ছিল না।
মেহেরু পিসির সামনের চেয়ারটা টেনে নিয়ে বসল। তার মুখে একটা অস্থির ভাব খেলছে। মহারাজের আকস্মিক রোগাক্রান্ত হয়ে পড়ার ঘটনা তার কাছে স্বাভাবিক বিষয় বলে মনে হচ্ছে না। বাতাসে কেমন রহস্যের গন্ধ পাচ্ছে সে। কুঞ্চিত কপাল নিয়ে যুবরাজ তুর্যয় হংসমনির উদ্দ্যেশ্যে একটি বার্তা লিখতে শুরু করল। লিখতে লিখতে হঠাৎ মনে হল দূর থেকে অস্পষ্ট হৈচৈ ভেসে আসছে। তাৎক্ষণিক ভাবে বাতায়নে ছুটে এলো। সকাল বেলার তাজা সূর্যের আলোয় ঝলমল করছে পাহাড়ের নিচের সমুদ্র। পাহাড়ের মাঝ বরাবর, নগরীর মাথার ওপরে মেঘ জমেছে। মেহেরু পাহাড়ের গায়ে শুধু মেঘ ছাড়া কিছুই দেখতে পাচ্ছে না এই মুহূর্তে। আজকের মেঘগুলো যেন একটু অন্যরকম। কৃষ্ণাভ, ভারী আর বিষণ্ণ! মেঘের আস্তর ভেদ করে একটা নারী কণ্ঠ ভেসে আসছে ওপরে। খুব আবছা। কিন্তু আবছা হওয়া স্বত্বেও মেহেরু কথাগুলো বুঝতে পারল। একটা অচেনা নারী কণ্ঠ অভিশাপ অভিশাপ বলে চেঁচিয়ে যাচ্ছে। তার বুকটা হঠাৎ এক অজানা আশঙ্কায় কেঁপে উঠল। কে এই নারী? কীসের অভিশাপের কথা বলছে?
#উড়ান_মেঘের_দেশে, #oran_megher_deshe
#ওয়াসিক_নুযহাত, #wasika_nuzhat_faria
সমুদ্রকুঞ্জ শত্রুদের হাত থেকে খুব একটা নিরাপদে ছিল না কখনওই। এর ইতিহাসে যুদ্ধ, বিগ্রহ এবং গণহত্যার ঘটনার অভাব নেই। কিন্তু শত্রুর আক্রমনের শঙ্কা ছাড়াও এই নগরীর অন্যরকম একটা ঝঞ্ঝাট আছে। এই ঝঞ্ঝাট সম্পর্কে অবগত লোকের সংখ্যা রাজ্যে হাতে গোণা কয়েকজন। মেহেরু সেই অল্প সংখ্যক লোকদের অন্তর্গত। এই বিশেষ ঝঞ্জাটের নাম হল জাদুবিদ্যা। পৃথিবীতে সমুদ্রকুঞ্জই একমাত্র রাজ্য যেখানে বিংশ শতাব্দীতেও জাদুর অস্তিত্ব বিদ্যমান।
No comments