গল্প | উড়ান মেঘের দেশে - পর্ব-০২ | Oran megher deshe - Part-02
লেখিকা | ওয়াসিকা নুযহাত
মেজো কুমার অজয়ের বাসগৃহটি মূল রাজভবন থেকে মাইল খানেক দূরে। মহলের চারিধার উঁচু পাচিল দিয়ে ঘেরা। সেই পাচিল দেশি বিদেশি নানাজাতের গুল্মলতা দিয়ে সাজানো। সিংহদ্বারের দুই পাশে দণ্ডায়মান শত বছরের পুরোনো ভাস্কর্য। মহলের সম্মুখে রয়েছে সুবিশাল চত্বর এবং মাঝারি আকারের জলাশয়। জলাশয়ের ভেতর থেকে মাথা ফুঁড়ে দাঁড়িয়ে আছে একটি অপূর্ব সুন্দর নারী মূর্তি। রাজপুত্র অজয় শিল্প সাহিত্যের অনুরাগী। চিত্রকর্মের প্রতি তাঁর প্রবল ঝোঁক। ইদানিং ভাস্কর্য কলায়ও আগ্রহ দেখা দিয়েছে। আজ দুপুরে শহরের সবচেয়ে নামকরা ভাস্কর স্বয়ং রাজপুত্র দ্বারা আমন্ত্রিত হয়ে মহলে আসবেন। অজয় প্রত্যুষেই পিতার অসুস্থতার খবর পেয়েছেন। রানিমা ভৃত্য মারফত খবর পাঠিয়েছেন অজয় যেন খুব দ্রুত মূল রাজভবনে উপস্থিত হন। অজয় ছোটবেলা থেকেই খুব একটা পিতাভক্ত নন। ছোট ছোট নানা ঘটনার মধ্যে দিয়ে তিনি অনুভব করেছেন পিতৃদেব অন্যান্য ভাইবোনদের প্রতি যতটা যত্নশীল তাঁর প্রতি ঠিক ততটা নন। তাছাড়া রাজ্যের শাসন ভারে অজয়ের সক্রিয় কোন ভূমিকা নেই, থাকবেও না কখনও। বড় রাজকুমার তুর্যয়কে যুবরাজ সম্মানে ভূষিত করা হবে শীঘ্রই। মহারাজ গত হওয়ার পর তুর্যয়ের মাথায়ই মুকুট বসবে। অজয়কে এখন অবধি প্রশাসনের কোন দায়িত্বে নিয়োগ দেয়া হয়নি। মহারাজের মতে তাঁর মেজো পুত্র দায়িত্বজ্ঞানহীন, বাউন্ডুলে স্বভাবের অপ্রাপ্তবয়স্ক একজন আহাম্মক তরুণ। এই নিয়ে অবশ্য অজয়ের ভেতরে খুব একটা আক্রোশ নেই। বরং দায়িত্বহীন, ছন্নছাড়া বিলাসবহুল দিন যাপনের মধ্যেই আপাতত তিনি আনন্দ খুঁজে পাচ্ছেন।
আজ প্রত্যুষে তিনি মূল রাজভবনে যাবার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন। ব্যক্তিগত ভৃত্যদের সর্বক্ষণ মনিবের নিকটে থাকা নিয়ম। অজয় অকারণে আশেপাশে কেউ ঘুরঘুর করা পছন্দ করেন না। তাঁর কক্ষে একটি কলিং বেল লাগানো আছে। ভৃত্যরা কক্ষের বাইরে অপেক্ষা করে। কলিং বেলের শব্দ শুনলেই দৌড়ে উপস্থিত হয়। রাজপুত্র রাজকন্যাদের সাজসজ্জায় ভৃত্যদের সাহায্য করার প্রচলন এখনো রয়ে গেছে। রাজসভা কিংবা যেকোনো রাজকীয় উদযাপনে রাজকুমারদের যথার্থ পোশাক পরিহিত অবস্থায় উপস্থিত হতে হয়। পোশাকটি হতে পারে প্রিন্সকোট অথবা শেরওয়ানি। কাঁধ থেকে বুকপকেট পর্যন্ত একটি স্বর্ণের চেইন ঝুলিয়ে রাখতে হবে। স্বর্ণমালার এই বিশেষ চিহ্নটি রাজপুত্রের পরিচয় বহনকারী।
#উড়ান_মেঘের_দেশে, #oran_megher_deshe
#ওয়াসিক_নুযহাত, #wasika_nuzhat_faria
আজ কী কারণে যেন তাঁর মেজাজ খিটখিটে হয়ে আছে। এই মুহূর্তে তিনি দাঁড়িয়ে আছেন নিজস্ব সাজঘরের আয়নার সম্মুখে। দামি মেহগনি কাঠের কারুকাজ খচিত আয়নাটি সিলিং থেকে মেঝে পর্যন্ত সুবিস্তৃত।। আয়নার ঠিক ওপরে পাঁচটি এল ই ডি বাল্ব জ্বলছে। এই ঘরের দেয়ালে গবাক্ষ বা ঘুলঘুলির অনুপস্থিতি বিধায় বাইরের সূর্যরশ্মি ভেতরে প্রবেশের উপায় নেই। রাজপুত্র এল ই ডি বাল্বের ঝকঝকে আলোতে আয়নায় প্রতিফলিত হওয়া নিজের মুখখানা অতি মনোযোগ সহকারে পর্যবেক্ষণ করছেন। যেন অচেনা কোনও মানুষকে আবিষ্কার করার চেষ্টা করছেন। তাঁর মুখের ধাঁচ লম্বাটে। উচ্চতায় পিতাকে ছাড়িয়ে গেছেন। ত্বক শ্যামবরণ। মাথার ঝাঁকড়া চুল ঘাড় ছুঁয়েছে। একজন ভৃত্য তাঁর গায়ে কোট পরিয়ে দিচ্ছিল। আরেকজন অনতিদূরে অপেক্ষা করছে। পোশাক পরিধান হয়ে গেলে রাজপুত্রকে জুতো পরানোর দায়িত্ব তার। এর মাঝেই তৃতীয় ভৃত্যটি স্বর্ণের পানপাত্র হাতে নিয়ে রাজপুত্রের সন্নিকটে দাঁড়িয়ে আছে। এটি একটি স্বাস্থ্যকর উপাদেয় পানীয়। নানারকম ওষধি উদ্ভিত দ্বারা তৈরি করা হয়। অজয় নিত্য ভোরবেলা এই পানীয়টি খালি পেটে পান করে থাকেন। আজকে তাঁর মধ্যে পানীয়র প্রতি কোনো আগ্রহ দেখা যাচ্ছে না। তাঁর কপাল কুঞ্চিত। ঠোঁটের কোণে বিরক্তি। চোখের রং রক্তের ন্যায় লাল। আজকের বাতাসে একটা অন্যরকম গন্ধ ঘুরে বেড়াচ্ছে।গন্ধটা কীসের তা ঠিক বুঝতে পারছেন না তিনি। চাকর গুলো আশেপাশে এসে ভিড়তেই গন্ধটা যেন আরও বেশি প্রকট হয়ে উঠেছে। কী রকম একটা আঁশটে ভাব। গায়ে কোট পরানোর জন্য চাকরটা যখন একদম শরীর ঘেঁষে দাঁড়ালো ঠিক সেই মুহূর্তে অজয় যেন তার ধমনীতে প্রবাহিত হওয়া রক্তের স্রোতের কল্লোল শুনতে পেলো নিজ কানে। কী আশ্চর্য! তাঁর ভেতরে যেন এক অচানা নতুন ইন্দ্রিয় জাগ্রত হয়ে উঠেছে। হাতপা নিশপিশ করছে অকারণে। বুক ভর্তি কীসের যেন নিরন্তর তৃষ্ণা! তেইশ বছরের তরুণ রাজার কুমার নিজের ভেতর এই আকস্মিক পরিবর্তন টের পেয়ে কিছুটা বিচলিত এবং উদ্বিগ্ন। তিনি হাত বাড়িয়ে পানপাত্র তুলে নিলেন। কয়েক চুমুক পান করার সঙ্গে সঙ্গে তাঁর বুক থেকে হেঁচকির মতো একটা শব্দ বের হয়ে এলো। ছুটে গেলেন বেসিনের কাছে। গলগল করে উগরে দিলেন মাত্র পান করা পানীয়র সবটুকু। খানিক বাদে প্রাত ভোজের আসনেও একই ঘটনা ঘটল। অজয় কিছুই খেতে পারলেন না। অল্প স্বল্প যা কিছু গলাধ:করণ করলেন তাও উগরে ফেলে দিতে হলো। মহারাজের সাথে সাক্ষাতের পরিকল্পনা ভেস্তে গেলো। অসুখের কথা জানতে পেরে স্বয়ং রানিমা রাজকুমারকে দর্শন করার সিদ্ধান্ত নিলেন।রাজকুমার সেই প্রস্তাব নাকচ করে দিলেন। তিনি কারো সাথেই সাক্ষাত করতে প্রস্তুত নন আজ। তবে দুপুর বেলায় ভাস্কর শিল্পী যখন উপস্থিত হল, রাজকুমার তখন আর না করলেন না। তাকে ডেকে আনলেন মহলের অভ্যন্তরে।
কক্ষ সংলগ্ন অলিন্দে আসন পেতে বসেছেন অজয়। তাঁর পরনে সুতির পাঞ্জাবি পাজামা। পাঞ্জাবির রং ঘিয়া। ঘাড় পর্যন্ত ঝুলে থাকা চুলগুলো ঝুঁটি বাঁধা। দাড়ি কামানো। চোখে সুরমা। চোখের রক্তাভ ভাব এখনও কাটেনি। সাদা কালো শ্বেত পাথরের চৌখুপি ওয়ালা মেঝের ওপর সেগুন কাঠের একটা ভারী গোল টেবিল রাখা। তার ওপর শোভা পাচ্ছে ফুলদানি সমেত বাগিচার কাঁচা লাল গোলাপ এবং সুরার পাত্র। রাজকুমারের ডানপাশে সুসজ্জিত এবং সশস্ত্র লম্বা চওড়া একজন দেহরক্ষী কঠোর মুখ নিয়ে নিষ্প্রাণ পাথরের ন্যায় দাঁড়িয়ে আছে। বামপাশের মাঝবয়সি ভৃত্যর হাতে রুপোর রেকাবি। রেকাবিতে রাখা দামি ব্র্যান্ডের সিগারেট এবং লাইটার। ভৃত্যরা সকলেই পুরুষ । রাজবাড়িতে একমাত্র মহারাজ ব্যতীত অন্য কোনও সদস্যের বিপরীত লিঙ্গের দাস দাসি পোষার অনুমতি নেই। স্বয়ং মহারাজও ব্যক্তিগত কাজে দাসিদের চেয়ে দাসদেরকেই প্রাধান্য দিয়ে থাকেন। তাঁর কতিপয় পছন্দের দাসি আছে যাদেরকে উপপত্নী বলা হয়ে থাকে। সেই উপপত্নীদের আলাদা থাকার ব্যবস্থা আছে। রাজ্যের সুন্দরতম মনোরম স্থান গুলোতে মহারাজ সেসব উপপত্নীদের বাসগৃহ নির্মাণ করে দিয়েছেন। মাঝে মাঝে হাওয়া বদলের উদ্দেশ্যে রাজামশাই এসব উপপত্নীদের বাড়িতে ভ্রমণ করেন। এই পর্যন্ত উপপত্নীদের গর্ভে মহারাজের দুজন কন্যাসন্তান জন্ম নিয়েছে। এরা কেউ রাজকন্যার উপাধি পায়নি।
#উড়ান_মেঘের_দেশে, #oran_megher_deshe
#ওয়াসিক_নুযহাত, #wasika_nuzhat_faria
মেজো রাজকুমার অজয় পাশে দাঁড়ানো ভৃত্যটিকে ইশারায় একটি সিগারেট ধরাবার জন্য আদেশ দিলেন। তাঁর সামনে এই মুহূর্তে বত্রিশ তেত্রিশ বছরের একজন যুবাপুরুষ বসে আছে। নাম শাহেদ আলি। গায়ে খয়েরি রঙের শার্ট, কালো প্যান্ট । গাল ভর্তি লম্বা দাড়ি।
-’শুনেছি আপনি একজন বিখ্যাত ভাস্কর শিল্পী।’
শাহেদ আলি কিঞ্চিৎ অপ্রতিভ কণ্ঠে বলল, ‘তেমন বিখ্যাত কেউ নই আমি মাননীয় রাজকুমার! কিছু লোকে চেনে আর কি!’
অজয় এখনও বাতাসে সেই অদ্ভুত গন্ধটা পাচ্ছেন। আশেপাশে দাঁড়ানো প্রতিটা মানুষের হৃদ স্পন্দন এবং রক্তের প্রবাহ যেন কলকল করে ডাকছে তাঁকে। আশ্চর্য জনক ভাবে মানুষের অস্তিত্ব টের পাচ্ছেন না তিনি। টের পাচ্ছেন রক্ত মাংসের অস্তিত্ব। অভুক্ত পেটে ফুসফুস ভর্তি সিগারেটের ধোঁয়া টেনে নিয়ে বললেন, ‘আপনি আমাকে একটি ভাস্কর্য গড়ে দেবেন। সেই ভাস্কর্য শোভা পাবে আমার মহলের যেকোনো সুসজ্জিত প্রান্তে। কাজটা আপনি আমার সামনেই করবেন। আমি দেখতে চাই কী করে ত্রি-মাত্রিক শিল্পকর্ম গড়া হয়।’
-’নিশ্চয়ই! আপনার কথা মতোই কাজ হবে। ঠিক কী রকম ভাস্কর্য চাইছেন আপনি? নারীমূর্তি?’
-’হতে পারে।’
শাহেদ আলি বিচিত্র হাসি হেসে বলল, ‘অনাবৃত নারী দেহ হলে কেমন হয়?'
-’মন্দ হয় না। '
দোতলার এই অলিন্দ থেকে রাজবাড়ির পশ্চাৎ দিকের গোপন ফটকটি দেখা যায়। প্রাচীর ঘেরা বাগিচার অপর প্রান্তেই ফটক। খুব জরুরি প্রয়োজনে এই গোপন পথ ব্যবহার করা হয়। এই মুহূর্তে ফটকের দ্বার উন্মোচিত হয়েছে। একটি শেভরলে গাড়ি ফটক দিয়ে দ্রুত গতিতে বেরিয়ে পড়ছে। চালকের গদি দখল করে আছে একজন নারী। তার পরনে জলপাই রঙের সুতির শাড়ি। চোখে রোদ চশমা। পাশ থেকে এই নারীকে পুরনো দিনের ভারতীয় চলচ্চিত্রের নায়িকা শর্মিলা ঠাকুরের মতো দেখতে লাগে। শাহেদ আলি একে আগেও দেখেছে। সে অতি বিনয়ের সাথে রাজকুমারের কাছে আর্জি করল, ‘হুজুর! এই কাজের জন্য আমার একজন মডেল প্রয়োজন হবে।’
রাজবাড়িতে দাসি বাঁদির অভাব নেই। যেকোনো একজনকে ধরে এনে মডেল বানিয়ে দিলেই হবে। রাজকুমার বললেন, ‘সে ব্যবস্থা হয়ে যাবে।’
শেভরলে গাড়িটা তখন ফটক পেরিয়ে গেছে। তোরণ উঠে গেছে। শাহেদ আলি বন্ধ তোরণের দিকে দৃকপাত করে বলল, ‘বিশেষ কেউ হলে ভালো হয়।’
#উড়ান_মেঘের_দেশে, #oran_megher_deshe
#ওয়াসিক_নুযহাত, #wasika_nuzhat_faria
-’আপনার পছন্দের কেউ থাকলে বলুন।’
-’আছে একজন, কিন্তু আমি জানি না তাকে আপনি এই কাজের জন্য রাজি করাতে পারবেন কিনা।’
অজয়ের রাজকীয় আত্মসম্মানে একটু আঘাত লাগল, ‘আমি পারব না? আমার হুকুম অমান্য করার সাধ্য এই রাজ্যে কার আছে?’
-’জি হুজুর! এই কারণেই আপনার কাছে আর্জি করলাম। আপনি চাইলে নিশ্চয়ই পারবেন। রাজবাড়ির কর্মচারীদের মধ্যেই একজন বিশেষ রমণীরত্নর কথা এই মুহূর্তে আমার স্মরণে আসছে। তার শরীরে অন্যরকম একটা নিখুঁত ছন্দ আছে। সচরাচর এরকম গঠন নজরে পড়ে না।’
-বেশ তো! তাকেই মডেল বানানো হবে। আপনি এখন আসুন। কয়েকদিনের মধ্যে আমি যোগাযোগ করব আপনার সাথে। আমার ম্যানেজার নিচে উপস্থিত আছে। তার সাথে সম্মানীর ব্যাপারে কথা বলে নিন।’
শাহেদ আলি উঠে দাঁড়িয়ে কুর্নিশ করল। ঠিক সেই সময় অজয় ব্যাপারটা প্রথমবারের মতো লক্ষ্য করল। তার হাতে আচমকা এতো পশম এলো কোত্থেকে? নখ গুলোও যেন এক রাতের ভেতরেই অনেক খানি বর্ধিত এবং শানিত রুপ ধারণ করেছে। হঠাৎ চোখ পড়লে মনে হয় যেন কোন মানুষের হাত না, জন্তুর হাত!
--------------------------------
মেহেরু তাঁর বৃদ্ধা মা এবং ছোট বোনকে নিয়ে বাস করে শহরতলীর একেবারে শেষ মাথার একটি ভাঙ্গাচোরা একতলা বাড়িতে। রাজবাড়ির কর্মচারী হিসেবে এর চেয়ে মানসম্মত জায়গায় দিনাতিপাত করার সামর্থ্য তার আছে। কিন্তু বাড়িটি মেহেরুর বাবার তৈরি বলে এই বাড়ির প্রতি তাদের একটি বিশেষ মায়া আছে। বাবা মারা গেছেন বহুদিন হলো। মায়ের ইচ্ছে স্বামীর বাড়িতেই শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করার। রাজবাড়ি থেকে মেহেরুকে একটা শেভরলে গাড়ি দেয়া হয়েছে ব্যবহারের জন্য। সে নিজেই গাড়ি চালায়। সমুদ্রকুঞ্জের সাধারণ জনগণের গাড়ির চালক বা বাড়ির চাকর রাখার মতো বিলাসিতার সুযোগ নেই। এখানে শ্রমের মজুরি বেশ চড়া। শুধুমাত্র রাজবাড়ির সদস্যদের গাড়ির জন্যই আলাদা চালক রয়েছে। সেইসব চালকরা মোটা অংকের বেতন পায়। রাজবাড়ির চৌহদ্দির ভেতরে অবশ্য এখনও ঘোড়ার গাড়ি ব্যবহার করার রেওয়াজ আছে।
মেহেরু বেলা বারোটার দিকে তার সাদা রঙের শেভরলে নিয়ে রাজবাড়ি ছেড়ে বেরিয়ে পড়ল। মূল ফটকে তখনও সাংবাদিকদের ভিড়। ওই ভিড় এড়ানোর জন্য তাকে গোপন পথ ব্যবহার করতে হলো। তার গন্তব্য পাহাড়ের নিচের একটি গ্রামে। গ্রামের নাম অলকতলা। রানিমার বিশ্বস্ত কর্মচারীদের একজন বলেই অলকতলা গ্রামের এক অশীতিপর অভিজ্ঞতা সম্পন্ন গণককে প্রাসাদে নিয়ে আসার দায়িত্ব পড়েছে তার ওপর। রানিমা এই খবর গোপন রাখতে চান। গণক সাহেব এর আগেও বহুবার রানির সাথে সাক্ষাত করেছেন। প্রতিবারই কড়া নিরাপত্তা এবং গোপনীয়তা সহকারে। রাজকন্যা নীহারিকা গণক মশাইকে অত্যধিক ঘৃণা করেন। লোকে বলে গণকের একটি ভবিষ্যৎ বাণীর কারণেই আজ রাজকন্যার জীবন বন্দিশালায় রূপান্তরিত হয়েছে। স্কুল কলেজে নীহারিকা এবং তার বিশেষ নিকটতম কতিপয় সখীকে আলাদা পাঠদানের ব্যবস্থা করা হয়েছে। হাতে গোনা কয়েকজন সখী ব্যতীত সমুদ্রকুঞ্জের রাজকন্যার মনের মতো কোনও বন্ধু নেই। এমনকি ব্যক্তিগত সেলফোন থেকে সে কার সাথে কথা বলছে সেই খবরটুকুও গোপন সার্ভারের মাধ্যমে রানিমার কাছে পৌঁছে যায়। তাঁর কোনও ফেসবুক অ্যাকাউন্ট নেই, ইন্সটাগ্রাম, টুইটার নেই। স্বপ্ন ছিল বড় ভাইয়ের মতো একদিন বিদেশে উচ্চ শিক্ষা লাভের উদ্দেশ্যে পাড়ি জমাবে। স্বয়ং মহারাজকে মুখ ফুটে নিজের ইচ্ছা জ্ঞাপন করেছেন তিনি। মহারাজ সবটা শুনে নিয়ে সহাস্যে বদনে রায় দিয়েছেন, ‘বিয়ে হোক। তারপর ...।’
রাজকন্যার বয়স মোটে উনিশ। তার সখীদের কেউই এই বয়সে বিয়ের কথা ভাবছে না। প্রত্যকের এক বা একাধিক মন মতো সঙ্গী আছে। অন্যদিকে রাজকন্যা নীহারের আজ অবধি কোনও পুরুষ বন্ধু হয়নি। নিজের তিন সহোদর, পিতা এবং ভৃত্যকুল ব্যতীত অন্য কোনও পুরুষের সম্মুখীনই হয়নি সে কখনও। রাজকন্যারা অন্যান্য সাধারণ মেয়েদের মতো স্বাধীন ভাবে যত্রতত্র ঘুরে বেড়াতে না পারলেও এহেন অতিরিক্ত নিষেধাজ্ঞা আরোপ করার নজির হংসমনি বংশে এইই প্রথম। এই কড়া নিরাপত্তার কারণ সম্পর্কে রাজকন্যা সম্পূর্ণ ভাবে অবগত নন। পিতা মাতা উভয়েই এসব বিষয়ে কথা বলতে নারাজ। লোক মুখে শুনতে পেয়েছেন অলকতলা গ্রামের বুড়ো গণকের ভবিষ্যৎ বাণীই তার এই অবস্থার জন্য দায়ী। পিতামাতা এবং তিন সহোদরের চোখের মণি রাজকন্যা। সকলে তাকে প্রাণের চেয়ে অধিক ভালবাসে। কিন্তু কী অদ্ভুত কান্ড! এক কুচক্রী গণক বুড়োর কথায় রাজকন্যার জীবনযাত্রার ধরণ পাল্টে গেলো। অবিশ্বাস্য!
#উড়ান_মেঘের_দেশে, #oran_megher_deshe
#ওয়াসিক_নুযহাত, #wasika_nuzhat_faria
রাজবাড়ির অভ্যন্তরে কিছুই গোপন থাকে না। প্রতিটি দেয়ালের যেন শ্রবণ শক্তি আছে। মেহেরু তার ব্যক্তিগত বাহন সমেত অলকতলা গেছে বুড়ো গণককে প্রাসাদে নিয়ে আসার জন্য সেই খবরটাও রাজকন্যার কাছে পৌঁছে যেতে খুব বেশি সময় লাগল না। অন্তঃপুরে তখন রাজকন্যা নীহারিকার স্নানের আয়োজন চলছে। গোসল খানাটি রাজকন্যার শোবার ঘরের সাথে লাগোয়া। চারধারে কাচ দিয়ে ঘেরা। দিনের বেলা বাইরে থেকে এই কাচ ভেদ করে কিছু দেখা যায় না। রাতে পর্দা টেনে দিতে হয়। শ্বেতপাথরের সুপ্রশস্ত একটি চৌবাচ্চায় জল গরম করা হচ্ছে। দুজন দাসি সেই জলে রাজকন্যার পছন্দ মোতাবেক নানা ধরণের প্রসাধন মিশিয়ে দিচ্ছে। বিদেশি নামকরা ব্র্যান্ডের বাথ প্রোডাক্ট। জলের মধ্যে ফেনা তৈরি হয়েছে। সুগন্ধিতে ভরে উঠেছে চারপাশ। চৌবাচ্চার সাথে দুটো সিঁড়ি আছে। সেই সিঁড়ি বেয়ে চৌবাচ্চায় নামতে হয়। নীহারিকার পরনে একটি বাথরোব। তিনি চৌবাচ্চার শেষ সিঁড়িতে দাঁড়িয়ে দাসিদেরকে ইশারায় কক্ষ ত্যাগ করার আদেশ দিলেন। তাঁর গোলগাল আদুরে মুখে একটি গভীর বিষণ্ণতার ছায়া খেলছে। কোঁকড়ানো চুল ছড়িয়ে আছে পিঠময়। চুলগুলো আদতে কোঁকড়ানো নয়। প্রাসাদের নিয়মিত বিউটিশিয়ান গত বিকেলে কৃত্রিম উপায়ে তাঁর সোজা চুল বক্র করে তুলেছে। প্রায়শই নিত্য নতুন জামা পরে অভিনব সব সাজে সাজিয়ে তোলা হয় রাজকন্যকে। কিন্তু রাজকন্যার আজকাল এসব কিছুই ভালো লাগে না। এতো সেজে লাভটা কী? ফেসবুকে একটা ছবি পর্যন্ত আপলোড করার অনুমতি নেই। অন্যদিকে তাঁর সহোদরদের প্রত্যেকের ফেসবুক, টুইটারে লক্ষ লক্ষ অনুসারী। মাঝে মাঝে মনে হয় মেয়ে হয়ে জন্মানোই সবচেয়ে বড় পাপ। না না … আজকাল ছেলে মেয়েতে অত তফাৎ আছে নাকি? তাঁর পাপ হয়েছে রাজবাড়িতে জন্ম নিয়ে। একদিন এই রাজবাড়ির প্রাচীর তিনি ডিঙ্গিয়ে যাবেন। চলে যাবেন দূরে কোথাও। যেখানে সাধারণ মানুষের মতো বেঁচে থাকা যায়। নিশ্বাস নেয়া যায়। আহা কবে আসবে সেই মুক্তির দিন?
দাসিরা কক্ষ ত্যাগ করার জন্য উদ্যত হয়েছিল। সেই সময় মণিকা এসে হাজির হলো। মণিকার দাদা ছিল এই বাড়ির রাঁধুনি। বাবা শিক্ষা দীক্ষায় পারদর্শী হয়ে উঠেছিল বিধায় কর বিভাগে চাকরি হলো। কিন্তু কী কারণে যেন রাজবাড়ি ছেড়ে ওদের পরিবার অন্য কোথাও স্থানান্তরিত হলো না। নীহারিকার কাছের সখীদের মধ্যে মণিকা অন্যতম। তাকে ব্যতিব্যস্ত হয়ে গোসল খানায় ঢুকতে দেখে রাজকন্যা বুঝলেন নিশ্চয়ই কোনও গুরুত্বপূর্ণ কথা আছে। দাসিদেরকে বললেন, ‘তোমরা যাও। মণিকা থাকুক।’
মণিকার পরনে একটা লাল ব্লাউজ আর লাল ঘাঘড়া। ওড়নাটা বুকের একপাশে ঝুলছে। তার খুব নাচের শখ। রাজবাড়ির চৌহদ্দির একেবারে শেষ মাথায় হ্রদের ওপরে একটা মহল আছে। ওটাকে বলে জলমহল। জলমহলে প্রায় সময় নাচের মেয়েরা আসে। স্বয়ং মহারাজ বীরবল সেই নৃত্য দর্শন করেন, উপভোগ করেন। ঘুঙুরের ঝুমঝুম আর গানের শব্দে রাজবাড়ির বাতাস ভারী হয়ে ওঠে। সেই সময় অন্তঃপুরের মেয়েদের জলমহলের ধারেকাছে যাওয়া বারণ। কিন্তু মণিকা একদিন আম গাছের মগডালে চড়ে দুরবীন দিয়ে জলমহলের ভেতরটা দেখেছে। ঘাঘড়া পরা অপূর্ব সুন্দর মেয়েরা কী চমৎকার ভাবে তালে তালে নেচে যাচ্ছে! সেই থেকে মণিকার ঘাঘড়ার প্রতি বিশেষ প্রীতি জন্ম নিয়েছে। আকর্ষণ জন্মেছে নাচের প্রতিও। তার মা বলেছে ভদ্র ঘরের মেয়েরা নাকি নাচে না। ওসব নিচু স্তরের মানুষের কাজ। কথাটা মণিকা বিশ্বাস করেনি। নাচ একটি শিল্প। শিল্পকে যে মানুষ ধারণ করতে পারে নিজের মধ্যে, সে কোন দিক দিয়েই নিচু স্তরের হতে পারে না।
#উড়ান_মেঘের_দেশে, #oran_megher_deshe
#ওয়াসিক_নুযহাত, #wasika_nuzhat_faria
-’কিছু বলবি?’
মণিকা তার পায়ের গোড়ালি ছুঁয়ে থাকা ঘাঘড়া হাত দিয়ে খামচে ধরে একটু ওপরে তুলল। চৌবাচ্চার সিঁড়ির ওপর সাবধানে বসে পড়ে বলল, ‘ তোর টিচার কোথায় গেছে জানিস?’
লোক সম্মুখে মনিকা নীহারিকাকে আপনি সম্বোধন করে। একবার ভুল করে ভরা মজলিসে তুই বলে ফেলার অপরাধে চব্বিশ ঘণ্টা অভুক্ত থাকতে হয়েছিল। রাজ পরিবারের সদস্যদের যথার্থ সম্মান না দিলে কড়া শাস্তির নিয়ম আছে এই রাজ্যে।
-’কোথায় গেছে?’
প্রশ্নটা করতে করতে নীহারিকা গা থেকে বাথরোব খুলে রেখে পানিতে নেমে পড়লেন।
-’গেছে ওই বুড়ো গণককে রাজপ্রাসাদে নিয়ে আসতে।’
-’তুই কী করে জানলি?’
-’মা বলেছে।’
নীহারিকা তাৎক্ষণিক ভাবে কিছু বললেন না। মনিকার মায়ের গোপন চররা প্রাসাদের সর্বত্র ঘুরে বেড়ায় এটা তাঁর অজানা নয়। ব্যাপারটা খুব একটা সরল চোখে দেখেন না তিনি। মনিকা নিতান্তই সাদা সিধে মেয়ে বলে কিছুই গোপন রাখতে পারে না। তার পেটে কথা থাকে না। এ কারণে নীহারিকা আজকাল মণিকার সামনে একটু সতর্ক থাকার চেষ্টা করেন। তবে আজ মনে হল নীহারিকার এই সরলতাকে একটু কাজে লাগালে মন্দ হয় না।
-’অ্যাই মণি, তুই আমার একটা উপকার করতে পারবি?’
-’কী উপকার?’
-’ওই বুড়ো ভাম রানিমার সাথে কী বিষয়ে কথা বলে সেই খবর এনে দিতে পারবি?’
-’কোনও ব্যাপার?’
-'ব্যাপার না?’
-’নাহ ...তবে বিনিময়ে তুই আমাকে কী দিবি বল?’
নীহারিকা চৌবাচ্চার সুগন্ধি উষ্ণ জলে গা ডুবিয়ে দিয়ে বলল, ‘কী চাই?’
#উড়ান_মেঘের_দেশে, #oran_megher_deshe
#ওয়াসিক_নুযহাত, #wasika_nuzhat_faria
-’তুই মাকে বলবি আমরা দুজন ঘোড়া চালানো শিখতে চাই।’
-’তোর হঠাৎ ঘোড় সাওয়ারী হবার শখ হলো কেন?’
-’স্টেবলে একটা ছেলে কাজ করে। নতুন এসেছে রাজবাড়িতে। ওকে আমার খুব পছন্দ। ঘোড়া চালানো শিখলে আমি ওর কাছেই শিখব!'
রাজকন্যার ঠোঁটে তাচ্ছিল্য এসে ভিড় করে, ‘স্টেবলের ছেলে? তোর মাথাটা একদম গেছে। ক্লাস বলে একটা ব্যাপার আছে জানিস তো? ছিঃ তোর রুচি দেখলে আমার গা ঘিনঘিন করে।’
-’দ্যাখ নীহার, তুই রয়্যাল আমি জানি। কিন্তু আমি রয়্যাল না। হতেও চাই না। আমার ওই জলমহলে নাচা নর্তকীদের কেই আপন মনে হয়, আর স্টেবলে দিনরাত খেটে যাওয়া সেই ছেলেটা … আহা দেখলে মন কেমন করে! তুই যদি দেখতিস একবার! নির্ঘাত প্রেমে পড়তিস …’
-’কখনওই না! আস্তাবলের গেঁয়ো অশিক্ষিত ছেলের প্রেমে পড়বে সমুদ্রকুঞ্জের রাজকন্যা? এমনটা ভাবার সাহস হলো কী করে তোর?'
মণিকা কটাক্ষ করে, ‘এত অহংকার করিস না। তোর রাজকুমার ভাইদের থেকে হাজার গুণ ভালো বুঝলি?’
-’বাজে কথা বলিস না।’
-’ঠিকই বলছি। যা প্রিন্স চার্মিং একেকজন! দেখতে ইচ্ছা করে না!’
-’তোকে দেখতে বলেছে কে? না দেখলেই হয়!'
মণিকার ঠোঁটে একটা রহস্যের হাসি ফুটে উঠল ক্ষণিকের জন্য, ‘বড় রাজকুমার আসছে … জানিস তো?’
মণিকার হাসিটা ভালো লাগলো না নীহারিকার। একটু বিরক্তি নিয়ে বললেন, ‘হ্যাঁ জানি। তুই এখন যা। গণকের ব্যাপারে তথ্য চাই আমার। মনে রাখিস।’
-’আমারও ঘোড় সাওয়ারী হবার অনুমতি চাই। মনে রাখিস।’
-’এটা কোনও ব্যাপার না। আজ বিকেলেই আমরা ঘোড়ায় চড়ব। তোর ওই আস্তাবলের রাখালকে খবর দিয়ে রাখিস। ফোন নম্বর আছে?’
#উড়ান_মেঘের_দেশে, #oran_megher_deshe
#ওয়াসিক_নুযহাত, #wasika_nuzhat_faria
-’যোগাড় করেছি!’
-’তুই পারিসও বটে। শেষ পর্যন্ত আস্তাবলের কর্মচারী? হাসালি আমাকে সত্যি!'
-----------------------------------------------------
No comments