গল্প | উড়ান মেঘের দেশে - পর্ব-০৫ | Oran megher deshe - part-05
লেখিকা | ওয়াসিকা নুযহাত
রাশিকা চমক সমৃদ্ধ বক্ষ নিয়ে ঘুরে তাকালো। সাদা রঙের শেভরলে গাড়ির জানালায় একজন যুবতী
গলা বাড়িয়ে রেখেছে। চোখে জিজ্ঞাসা চিহ্ন। রাশিকা হাত নেড়ে মিষ্টি করে বলল, ‘হ্যালো!’যুবতীর মুখ ভ্রুকুটিবক্র, ‘কী চাই আপনার?’
রাশিকা এই খটোমটো প্রশ্নের সম্মুখীন হয়ে একটু বিব্রত বোধ করল। এতো সুন্দর একটা মেয়ে কেন অযথাই স্কুলের হেড মিস্ট্রেসের মতো কঠিন সুরে কথা বলবে ব্যাপারটা তার বোধগম্য হচ্ছে না। হঠাৎ মাথায় চলে এলো প্রশ্নটা। এই মেয়ে রাজকন্যা নয় তো? কথাটা মনে হতেই সে আনন্দে আপ্লুত হয়ে ফড়িং এর মতো তিড়িং বিরিং করে এক লাফে গাড়ির কাছে চলে এলো। জানালায় মুখ নামিয়ে ভারী বিগলিত হাসি হেসে বলল, ‘আপনি কি রাজকন্যা?’
মেহেরুর কন্ঠ থেকে বিরক্তি ঝরে পড়ল, ‘আপনি আমার প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে আমাকেই প্রশ্নের ওপর প্রশ্ন করে যাচ্ছেন? মতলবটা কী আপনার?’
রাশিকা নাছোড় গলায় বলল,’বলুন না প্লিজ! আপনি কি রাজকন্যা? আমার একটা সত্যিকারের রাজকন্যা দেখার অনেকদিনের শখ!’
-’না আমি রাজকন্যা নই। রাজবাড়ির কর্মচারী।’
-’ধুর!' হতাশ হয়ে জানালা থেকে মুখ সরিয়ে আনে রাশিকা।
-’আপনার পরিচয়টা জানতে চাইছি। কেন এসেছেন এখানে?’
-’আমার পরিচয় হলো আমি আপনার কলিগ।’
-’মানে কী?’
রাশিকা চাকরির নিয়োগপত্রটা মেহেরুর চোখের সামনে তুলে ধরল। ততক্ষণে দুজন প্রহরী তার পশ্চাৎপটে এসে দাঁড়িয়েছে। পাথরের মতো মুখ করে বলছে, ‘আপনার পরিচয়?’
'#bangla_story_143' '#banglastory143'
রাশিকা কাঁচুমাচু গলায় বলল, ‘আমি চোর না ভাই। আমি একজন শেফ। এভাবে কথা বলার কিছু নেই। বুঝলাম না, এই দেশে কি সবাই এরকম লোহার মতো গমগম করে কথা বলে? আমার ট্যাক্সি ড্রাইভারটাও ছিল লোহামুখো। '
মেহেরু নিয়োগপত্রটায় চোখ বুলিয়ে নিয়ে আদেশ দেবার সুরে বলল, ‘গাড়িতে উঠে বসুন।’
রাশিকা ইয়া বড় মোটাসোটা স্যুটকেসটা অনেক কষ্টে টেনে টুনে গাড়ির কাছে নিয়ে এলো। প্রহরীদের একজনকে খিটখিট করে বলল, ‘ব্যাক্কলের মতো দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখছেন কী? স্যুটকেসটা ধরুন! সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিন।’
প্রহরী এই অতি আধুনিক বাকপটু মেয়ের ধমক খেয়ে একটু অপ্রস্তুত হয়ে পড়ল। তড়িঘড়ি করে সুটকেসটায় হাত লাগালো। রাশিকা মেহেরুর পাশের সিটে উঠে বসতে বসতে বলল, ‘ভালোই হল আপনাকে পেয়ে। আমার তো কেমন যেন ভয় ভয় করছিল। এতো বড় ভূতের মতো রাজবাড়ি! দেখেই কেমন গা ছমছম করছিল। বাবারে বাবা!’
সিংহদ্বার উন্মোচিত হয়েছে। মেহেরু গাড়ি ড্রাইভ করছিল আর আড়চোখে আবোলতাবোল মেয়েটিকে দেখছিল। রিভারটেড বব চুল, পরনে শার্ট প্যান্ট, ডাগর দুটি চোখ, থুঁতনিতে ডিম্পল, মুখে বালিকাসুলভ সরল লাবণ্য, সব মিলিয়ে মেয়েটি দেখতে ভারী আকর্ষণীয়। কিন্তু স্বভাবটা যেন কেমন ছন্নছাড়া। একটা মুহূর্তও যেন স্থির হয়ে থাকতে পারে না। এই মেয়ে হবে রাজবাড়ির হেঁশেলের বাবুর্চি? একে জোকার টোকার হলে মানাতো বরং, বাবুর্চি হিসেবে তো একেবারেই মানায় না! মেহেরুর ঠোঁটে একটা মুচকি হাসি লেগে আছে। গণক মশাইকে তার গ্রামে নামিয়ে দিয়ে মাত্র ফিরল সে। প্রায় ঘণ্টা খানেকের ড্রাইভ। ক্লান্ত লাগছিল। তবে ফেরা মাত্র এই জোকার মেয়েটার কাণ্ড কারখানা দেখে পথের সব ক্লান্তি নিমেষে উড়ে গেছে। জোকারটা এখন বড় বড় চোখ মেলে এদিক সেদিক তাকাচ্ছে। যেন সে সমুদ্রকুঞ্জে নয়, এসেছে অ্যালিসের ওয়ান্ডারল্যান্ডে।
গাড়ি এগিয়ে যাচ্ছে পরিষ্কার রুপো রঙের ঝকঝকে পিচ ঢালা রাস্তার ওপর দিয়ে। দুপাশে সবুজ ঘাস। ঘাসের ওপর ফুটে থাকা নানা বর্ণের ফুল। কোথাও আছে ফোয়ারা, কোথাও আবার শত বৎসরের পুরনো ভাস্কর্য। রাশিকার চোখ দুটো বিস্ময়ে ছানাবড়া হয়ে গেছে। সে এক মধুময় আবেশ ডোবা কণ্ঠে বলল, ‘ওয়াও! আমার বিশ্বাস হচ্ছে না সত্যিই আমি রাজবাড়ির ভেতর ঢুকে পড়েছি। কত দিন দিবাস্বপ্ন দেখেছি এই মুহূর্তটাকে নিয়ে। অসাম! অসাম!’ একটু থেমে মেহেরুর দিকে তাকিয়ে বলল, ‘আমার কি এখন মহারাজের সাথে দেখা করতে হবে?’
মেহেরু অনেক ক্ষণ ধরে চেপে রাখা হাসিটা এবার ফিক করে হেসে ফেলল। বাবুর্চি নাকি দেখা করবে মহারাজের সাথে। এর চেয়ে হাস্যকর কথা কেউ কোনদিন শুনেছে?
-'হাসছেন কেন?' রাশিকার গুরুগম্ভীর প্রশ্ন।
মেহেরু অন্যদিকে মুখ ঘুরিয়ে হাসিটা লুকনোর চেষ্টা করে বলল, ‘আপনার কাজ তো রাজবাড়ির রসুইঘরে। মহারাজের সাথে দেখা করে করবেনটা কী?’
-’হ্যাঁ সেটা ঠিক আছে। কিন্তু আমি তো মহারাজের চাকরিই করছি তাই না?’
'#oran_megher_deshe' '#উড়ান_মেঘের_দেশে'
'#bangla_story_143' '#banglastory143'
-’আমি আপনাকে এখন অফিস বিল্ডিং এ নিয়ে যাচ্ছি। ম্যানেজারের সাথে আপনার সাক্ষাত হবে। তিনিই আপনার ইমিডিয়েট বস।’
রাশিকা একটি প্রলম্বিত হতাশ শ্বাস ছেড়ে আফসোস মাখা কন্ঠে বলল, ‘হায় হায় তাহলে কি মহারাজের সাথে আমার কখনও দেখা হবে না?’
-’খুব গুরুতর প্রয়োজন ছাড়া তো দেখা হওয়ার সুযোগ নেই।’
রাশিকার মনটা ভারী খারাপ হয়ে গেলো, ‘এর মানে কি রাজা রানি রাজকন্যা রাজপুত্র এদের কারো সাথেই আমার দেখা হবে না?’
মেহেরু হাসতে হাসতে বলল, ‘মাত্র তো এলেন। রানিমাকে নিশ্চয়ই দেখার সুযোগ হবে। রাজকন্যাকেও।’
-‘আর রাজপুত্র?’ ভারী করুণ শোনায় রাশিকার গলা।
মেহেরু হাসে, ‘কোন রাজপুত্র? বড়? মেজো? নাকি আমাদের ছোট কুমার?’
রাশিকা গলন্ত মোমের মতো নরম স্বরে ইনিয়ে বিনিয়ে বলল, ‘বড় রাজপুত্র তুর্যয় হচ্ছে আমার চাইল্ডহুড ক্রাশ। একটাবার তার সাথে দেখা করতেই হবে। বলতে পারেন তার সাথে মিট করার জন্যই আমি এতো কষ্ট করে চাকরি নিয়ে সমুদ্রকুঞ্জে এসেছি। প্লিজ আপা ..... আপনার পায়ে পড়ি.... আপনি একটা বার তার সাথে আমার দেখা করার ব্যবস্থা করে দিয়েন।’
কিম্ভূত মেয়েটার কিম্ভূত কথা শুনে মেহেরু এবার কেঁপে কেঁপে হাসতে লাগল। অভিমান ঝরে পড়ল রাশিকার কণ্ঠ থেকে, ‘আপনি হাসছেন? তুর্যয়ের প্রতি আমার প্রেম কতটা গভীর আপনি জানেন?
মেহেরু হাসতে হাসতে বলল, ‘আপনি কি জানেন? শুধু সমুদ্রকুঞ্জ, বাংলাদেশ কিংবা ভারতের মেয়েরাই নয়, পৃথিবীর নানা দেশের নানা বয়সী মেয়েরা আমাদের বড় কুমারের প্রেমে প্রতিনিয়ত হাবুডুবু খাচ্ছে। এতো এতো মেয়েদের ভিড়ে বড় কুমারের চোখ আপনার ওপর পড়বে বলে মনে হয়?’
-’পড়তেই হবে! আমাকে দেখুন, আমি কি যথেষ্ট সুন্দর নই?’ কথাটা বলে রাশিকা এদিক সেদিক তাকিয়ে মুখের নানা ভঙ্গিমা করতে লাগল। যেন তার ফটোশ্যুট হচ্ছে। মেহেরু রাশিকাকে এক নজর দেখে নিয়ে বলল, ‘আপনি নিঃসন্দেহে সুন্দরী।’
'#oran_megher_deshe' '#উড়ান_মেঘের_দেশে'
'#bangla_story_143' '#banglastory143'
রাশিকা খুব বিজ্ঞ গলায় রায় ঘোষনা করল, 'হুম সুন্দর তো আমি আছিই!' একটু থেমে কী যেন ভেবে নিয়ে আবার বলল, 'কিন্তু তুর্যয় একটু বেশিই সুন্দর। আমি ঠিক করেছি এখন থেকে রোজ রুপচর্চা করব। যাতে তুর্যয়ের সাথে ডেট নাইটের আগে আমার রুপ একদম ক্যাটরিনা টাইপ ফুরফুরা হয়ে যায়। বুঝলেন?’
-’বুঝলাম।’
অফিস দালানের সামনে গাড়ি থেমেছে। লাল ইটের প্রাসাদতুল্য দোতলা বাড়ি। স্থাপত্যে ভিক্টোরিয়া যুগের প্রভাব। রাশিকা গাড়ি থেকে নেমে ঘাড় উঁচু করে বাড়িটা দেখছে। মনে হচ্ছে মুগ্ধতায় সে জ্ঞান হারাবে। তার ঠোঁটে লেগে আছে বিজলিবাতির মতো হাসি। ডাগর দুটি চোখে সুখের উন্মাদনা। মেহেরু গাড়ি থেকে নেমে ব্যাক ডালা থেকে সুটকেসটা নামিয়ে দিল। রাশিকা জলপাই রঙের শাড়ি পরা মেহেরুর দিকে চেয়ে গদ্গদ গলায় বলল, ‘আপনি কিন্তু খুব ভালো।’
মুচকি হাসল মেহেরু, ‘ধন্যবাদ।’
-’আর আপনি দেখতেও সুপার ডুপার সুন্দর! বাপরে বাপ! আমি স্ট্রেইট না হলে নির্ঘাত আপনার প্রেমে পড়ে যেতাম।’
-’আবারও ধন্যবাদ।’ মেহেরুর মুখ থেকে হাসিটা এখনও সরেনি।
-’সিরিয়াসলি, আপনার এই ফুরফুরা রুপের রহস্য কী?’
মেহেরু অপ্রস্তুত বোধ করল, ‘আপনার এখুনি ম্যানেজারের সাথে দেখা করা উচিত। কিছুক্ষণের মধ্যেই অফিস বন্ধ হয়ে যাবে।’
-’জি আমি যাচ্ছি। তার আগে একটি প্রশ্ন, আপনি কি ম্যারিড?’
-’না।’
-’গ্রেট! আমার একটা শয়তান ভাই আছে। আমার চেয়ে দু বছরের বড়। মনে মনে শয়তান হলেও মনের দিক থেকে হান্ড্রেড পার্সেন্ট ফেরেশতা। বিসিএস প্রিলিতে টিকে গেছে। আচ্ছা আপা, আমার ভাইটির সাথে আপনার একটা বিয়ে দিলে কেমন হয়?’
মেহেরু এবার বিরক্তি নিয়ে বলল, ‘আমার বয়স তিরিশ। আমার ধারণা আপনার ভাই আমার চেয়ে বয়সে ছোট হবে। তাছাড়া আমার বিয়ে করার কোনও প্ল্যান নেই।'
রাশিকা জিব দিয়ে চুকচুক শব্দ করে। আফসোসের গলায় বলে, ‘ইশ আমার শয়তান ভাইটার ভাগ্যটা আসলে খারাপ। তবে আপনার বয়স তিরিশ কোন ভাবেই মনে হয় না। দেখলে মনে হয় আপনি আমার সমান। হিহি!’ রাশিকা কথাটা বলে দাঁত বের করে হাসতে লাগল। যেন খুব মজার কথা বলে ফেলেছে।
মেহেরু আলোচনায় ইতি টানল, ‘আপনি ভেতরে যান। আমি আজকের মতো আসি।’
রাশিকাকে আর কিছু বলার সুযোগ না দিয়েই মেহেরু গাড়িতে উঠে পড়ল। অহেতুক বকবক করার সময় এটা নয়। অনেক কাজ পড়ে আছে। আজ বাড়ি ফিরতে ফিরতে রাত হবে। বড় রাজকুমারের মহলের সাজসজ্জা চলছে। রানিমা আজকাল মেহেরুর ওপর একটু বেশিই নির্ভরশীল হয়ে উঠেছেন। প্রায় প্রতিটা কাজেই তিনি মেহেরুকে জড়িয়ে ফেলছেন। মেহেরু অবশ্য রানিমার এতটা আস্থা অর্জন করতে পেরে মনে মনে গর্বিত। কিন্তু যে কোনো ক্ষেত্রে পদন্নোতি হওয়ার সাথে সাথে পাল্লা দিয়ে বাড়তে থাকে দায়িত্বের বোঝা। মেহেরু মহারানির বিশ্বাসভাজন কর্মচারীদের একজন বলেই তার কাঁধে অষ্টপ্রহর পাথরের মতো চেপে বসে আছে হাজারটা কাজের চাপ। ব্যক্তিগত জীবন বলতে কিছুই আর অবশিষ্ট নেই। তার সমস্ত জীবনীশক্তি রাজবাড়ির সেবা করতে গিয়েই নিঃশেষ হয়ে আসছে। এর বিনিময়ে সে তার মা আর ছোটবোনকে খাওয়াতে পড়াতে পারছে। এইই বা কম কী? বাবা চলে যাবার পর সংসারের হাল তো তাকেই ধরতে হয়েছে। নিজেকে নিয়ে সে ভাবে না। ছোট বোন টাকে পড়াশোনা করিয়ে মানুষের মতো মানুষ বানাতে পারলেই তার জীবন সার্থক।
'#oran_megher_deshe' '#উড়ান_মেঘের_দেশে'
'#bangla_story_143' '#banglastory143'
রাজকুমার তুর্যয়ের মহলের সামনে এসে গাড়ি থামালো মেহেরু। প্রায় জনা পঞ্চাশেক লোক কোমর বেঁধে যোগ দিয়েছে সুবিশাল মহলটির পরিচর্যার এই বর্ণাঢ্য আয়োজনে। বাগানে ফুটন্ত গোলাপের চারা লাগানো হচ্ছে। প্রাসাদের প্রতিটি অলিন্দ সাজানো হচ্ছে অর্কিড গুল্মলতা দিয়ে। নতুন নতুন দামি ব্র্যান্ডের আসবাব এসেছে ট্রাকে করে। হৈচৈ করে সেসব আসবাব ভেতরে ঢুকানো হচ্ছে। জাপান থেকে একজন নামকরা ইন্টেরিওর ডেকোরেটর এসেছেন মহারানীর আমন্ত্রণ পেয়ে। তার পরিকল্পনা মোতাবেকই সাজসজ্জার কাজ এগিয়ে যাচ্ছে। মেহেরুর ওপর দায়িত্ব পড়েছে এই সমস্ত কাজ তদারক করার। রানিমা বড় পুত্রকে বরণ করে নেয়ার আয়োজনে কোন ত্রুটি রাখতে চান না। অথচ তুর্যয়কে মেহেরু ছোটবেলায় যেমনটা দেখেছে, যদি বদলে গিয়ে না থাকে, তাহলে এসব বিলাসবহুল সাজসজ্জা তার মন কাড়বে না কিছুতেই। তুর্যয়ের ক্ষমতা কিংবা বিলাস ব্যসনের তৃষ্ণা নেই। তার আছে জ্ঞানের তৃষ্ণা। মেহেরুর সমগ্র শিক্ষক জীবনে তুর্যয়ের মতো মনোযোগী এবং জ্ঞানপিপাসু ছাত্র আর দ্বিতীয়টি ছিল না। থাকবেও না কখনও।
মহলের সিঁড়ি বারান্দায় একজন যুবাপুরুষ ভাস্কর্যর কাজ করছিল। এই শিল্পীকে মেহেরু চেনে। রাজবাড়িতে এর অবাধ যাতায়াত। কোন এক বিচিত্র কারণে লোকটাকে দেখলেই তার অন্তরে একটা তিতকুটে অনুভূতি হয়। ভালো লাগে না। আজকে মেহেরু বারান্দায় উঠে আসতেই লোকটা তার ওপর দৃষ্টি ন্যাস্ত করল। হেসে বলল, ‘ম্যাডাম! আছেন কেমন?’
মেহেরু সরাসরি প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে একটু গম্ভীর ভাবে বলল, ‘সব ঠিক আছে?’
লোকটার চোখ অনায়াসে নেমে আসে মেহেরুর শরীরের ওপর। সেই চাউনিতে কোনও ভক্তি শ্রদ্ধা নেই। বরং কেমন একটা লোভাতুর ভাব আছে। গা গুলিয়ে আসে মেহেরুর। তীক্ষ্ণ গলায় বলে, ‘মনোযোগ দিয়ে কাজ করুন। রানিমা আমাকে পাঠিয়েছেন সব কাজ ঠিক মতো চলছে কিনা সেই ব্যাপারে তদারক করতে।’
‘আপনি এসে গেছেন। এখন সব কাজ বাতাসের চেয়ে দ্রুত গতিতে হয়ে যাবে। বুঝলেন ম্যাডাম?’
মেহেরু আর কোন কথা না বাড়িয়ে ভেতর বাড়িতে ঢুকে পড়ল। ঠিক সেই সময় তার সেলফোনটা বেজে উঠল ঝনঝন করে। রাজকন্যা নীহারিকার বান্ধবী মণিকা ফোন করছে। মেহেরু হ্যালো বলতেই ওপাশ থেকে নীহারিকার উত্তেজিত কণ্ঠস্বর শুনতে পেলো, ‘তুমি কোথায় আপা?’
-’কী হয়েছে?’
নীহারিকা চাপা গলায় বলল, ‘একটা ঝামেলা হয়ে গেছে। বিরাট বড় ঝামেলা। প্লিজ তুমি এখুনি আমার কাছে একবার এসো।’
-’কিন্তু …’
-’কোনও কিন্তু নয়। তুমি এখুনি এসো আপা। আমার ভয়ঙ্কর বিপদ!’ নীহারিকার কান্না বিজড়িত কণ্ঠস্বর মেহেরুর আত্মা কাঁপিয়ে দিয়ে গেলো। এই বালিকাটিকে সে ছোট বোনের মতো স্নেহ করে। রাজকন্যাসুলভ দাম্ভিক কোন আচরণ সে এর কাছ থেকে কোনদিন পায়নি। শুধুমাত্র মেজো কুমার অজয় ব্যতীত মহারাজের পুত্র কন্যাদের মধ্যে কেউই উদ্ধত বা দর্পিত স্বভাবের অধিকারী নয়। অজয়টা যেন কেমনতর! খুব অহংকারী আর রগচটা।
মেহেরু কী করবে বুঝতে পারছে না। স্বয়ং রানিমার নির্দেশ মোতাবেক সে এই মহলের সাজসজ্জার তদারক করতে এসেছে। এখন নীহারিকার ডাকে সাড়া দিতে হলে রানিমার আদেশ অমান্য করা হবে। কী মুশকিলেই না পড়া গেলো!
'#oran_megher_deshe' '#উড়ান_মেঘের_দেশে'
'#bangla_story_143' '#banglastory143'
--------------------------------------------------
ঘটনা এহেন গুরুতর মোড় নেবে তা রাজকন্যা কিংবা তার সখী ভুলেও ধারণা করতে পারেনি। অনেকটা ঠাট্টার ছলেই দুজনে মিলেমিশে সিদ্ধান্ত নিয়েছিল ইশানকে শাস্তি দেবে। বেচারা ইশানের এমন মর্মান্তিক অভিজ্ঞতা এর আগে কখনও হয়নি। সে বুঝতে পারছে এই দুই রমণীর সংসর্গ তার জন্য বিপজ্জনক কিন্তু সে না পারছে সইতে, না পারছে কিছু বলতে। তার ভেতরটা নিদারুণ এক অসহায়ত্ব এবং ক্রোধের অনলে টগবগ করছে। রাজকন্যার মর্জি মোতাবেক মূল রাজভবন পর্যন্ত তাকে ঘোড়া সমেত আসতে হয়েছে। প্রাসাদের দ্বিতীয় তলার সর্ব দক্ষিণের সুবিশাল কক্ষটি রাজকন্যার দখলে। তার কক্ষের সাথে রয়েছে একটি প্রশস্ত অলিন্দ। রাজকন্যা হুকুম করেছে ইশান যেন ঠিক সেই অলিন্দর নিচের আঙিনায় দাঁড়িয়ে কান ধরে পাঁচশবার ওঠাবসা করে। অগত্যা ইশানের হুকুম তামিল করতেই হল। সে গরীবের ছেলে। রাজ্যের রাজকন্যার মুখের ওপর কথা বলার স্পর্ধা তার নেই। কিন্তু এই ঘটনায় তার ভেতরের আত্মসম্মানের ভিতটা নড়বরে হয়ে যাচ্ছিল। এই দুর্বিষহ অপমানের পর অনেকদিন হয়তো সে নিজের দিকেই নিজে চোখ তুলে তাকাতে পারবে না। আর যদি এই খবর কোন ভাবে চাউর হয়ে যায় শহরতলিতে, তবে লজ্জায় মাথা কাটা যাবে তাদের পুরো পরিবারের। গরিব হলেও মান সম্মান নিয়ে কোন রকমে এতকাল বেঁচে ছিল তার অসুস্থ বৃদ্ধ বাবা। আজকের ঘটনার পর সে বাবার সামনে কোন মুখ নিয়ে দাঁড়াবে?
তবে খবরটা আপাতত শহরতলী অবধি পৌঁছুল না। পৌঁছুল অন্দরমহলে, স্বয়ং রানিমার আসনে। দুর্ভাগ্যবশত মহারাজ বীরবল তখন রানিমার কক্ষে পদধূলি দিতে এসেছিলেন। তাঁর শরীর অতিশয় দুর্বল। তবুও ডাক্তার পরামর্শ দিয়েছেন হাঁটা চলা অব্যাহত রাখার। শরীরের পেশি এবং রক্তের সঞ্চালন যত বৃদ্ধি পাবে, ততই আয়ু বৃদ্ধির সম্ভাবনা তৈরি হবে। মহারাজ অন্দরমহলে উপস্থিত হবার কিয়ৎ ক্ষণের মধ্যেই রানিমার নিজস্ব কম্পিউটারের মনিটরে বহুদিনের পুরনো দাসি শঙ্খবালার মুখখানা ভেসে উঠল। রানিমা মহারাজের অনুমতি নিয়ে শঙ্খবালার ভিডিও কল গ্রহণ করলেন। ওদিকে রাজকন্যা নীহারিকা এবং তার সখী মণিকা তখন প্রাসাদ সংলগ্ন ঝুল বারান্দায় বসে আছে। রাজকন্যার দুজন ব্যক্তিগত দাসিও উপস্থিত আছে ঘটনাস্থলে। ইশান দাঁড়িয়ে আছে নিচের আঙিনায়। তার মুখটা ওপরের দিকে তাক করা। কানের লতিতে হাত। নীহারিকা খিলখিল করে হেসে যাচ্ছিল। তার এই নিস্তরঙ্গ নিরানন্দ জীবনে যেন অনেকদিন বাদে একটি আনন্দের ঘটনা ঘটল। সে হাসতে হাসতে বলল, ‘শুধু কান ধরে থাকলে হবে না। ওঠ বস করতে হবে।’ এই কথা শুনে মণিকা এবং উপস্থিত দুজন অল্প বয়সী দাসি সশব্দে হেসে উঠল। সেই হাসিটা কেন যেন ভালো লাগল না নীহারিকার। সে ক্ষিপ্ত হয়ে বলল, ‘অ্যাই তোরা কেন হাসছিস? এখানে হাসার কী আছে?’
দাসি দুজন চকিতে মুখ থেকে হাসি সরিয়ে নিতে বাধ্য হলো। এই রাজকন্যার মতগতি তারা কিছুই বোঝে না। নিজেই কিন্তু হেসে কুল পাচ্ছে না। অথচ তারা একটু হাসলেই যত দোষ। দাসি হয়েছে বলে যেন তাদের হাসার অধিকার টুকুও নেই। কিছুক্ষণের মধ্যেই আঙিনায় ভৃত্যদের একটি ভিড় জমে গেলো। সবাই তামাশা দেখতে ছুটে এসেছে।
ইশান কান ধরে ওঠ বস করছে। ভৃত্যকুল মিটমিট করে হাসছে। কেউ কেউ আবার মোবাইলে ভিডিও ধারণ করছে। ইশানের চোখ মুখ পাথরের মতো শক্ত। অপমানে তামাটে গাল অরুণ বরণ হয়ে উঠেছে। নীহারিকা ওই তামা রঙের থমথমে মুখটার দিকে তাকিয়ে ছিল। ওই মুখটায় কেমন যেন একটা মায়া আছে। চেয়ে থাকতে ভালো লাগে। এর মাঝেই তার চোখ পড়ল ভৃত্যদের হাস্যরত দলটার ওপর। অমনি হুঙ্কার ছেড়ে বলল, ‘তোরা এখানে কী করছিস? সিনেমা হচ্ছে নাকি? এখুনি চলে যা এখান থেকে!’
ভৃত্যদের দলটা তড়িঘড়ি করে নিষ্ক্রান্ত হল। এবং মুহূর্তের মাঝে খবরটা পার হয়ে গেলো শঙ্খবালার কানে। শঙ্খবালার কানে কোনও খবর যাবে আর রানিমা সে সম্পর্কে অবগত হবেন না সে এক অসম্ভব ব্যাপার। শঙ্খবালার কাছ থেকে প্রাপ্ত তথ্যটা অনেকটা এরকম যে, আস্তাবলের কাজে নিয়োগ পাওয়া নতুন ছোকরাটা সুযোগ বুঝে রাজকন্যার হাত ছুঁয়ে দিয়েছে। এবং রাজকন্যার মুখের দিকে চেয়ে আবোলতাবোল কথা বলেছে। এর শাস্তি স্বরূপ রাজকন্যা ছোকরাটাকে কান ধরে উঠ বস করার হুকুম দিয়েছেন। ইশানের ভাগ্যটা নিতান্তই খারাপ বলতে হয়। কারণ সচরাচর অন্দরমহলের ক্ষুদ্র ঝামেলা গুলোর আঁচ মহারাজের কান পর্যন্ত যাবার আগেই নিষ্পত্তি হয়ে যায়। আজকে শঙ্খবালার মুখ নিঃসৃত কথা গুলো মহারাজ নিজ কানে শ্রবণ করলেন।
হুঙ্কার ছেড়ে মহারানি ঊর্মিলাকে বললেন, ‘তোমার মনিটরে সিসি ক্যামেরা অন করো। আমি নিজ চোখে দেখতে চাই।’
সিসি ক্যামেরার ফুটেজে দেখা গেলো, একজন অল্পবয়সী টগবগে তরুণ, নীহারিকার কক্ষ সংলগ্ন অলিন্দের ঠিক নিচ বরাবর আঙিনায় দাঁড়িয়ে আছে। শুধু এইই নয়, সে রাজকন্যার চোখে চোখ রেখে, বুক চিতিয়ে কথা বলছে। আদতে তখন রাজকন্যা, ইশানের শাস্তি মওকুফ করে দিয়েছে। কারণ তার বুকের ভেতর ওই দরিদ্র ছেলেটার জন্য একটা অনাহূত মায়া প্রদীপের দুর্বল শিখার মতো তিরতির করে কেঁপে কেঁপে উঠছিল অনবরত।
মহারাজের মুখের ভাব ক্রূর হতে খুব বেশি সময় লাগল না। তিনি সিংহের ন্যায় গর্জন করে উঠে বললেন, ‘ওই হারামজাদার চোখ উপড়ে ফেলা হোক! আমার কন্যার দিকে চোখ তুলে তাকায়, এতো বড় সাহস!’
হংসমনি রাজবংশে প্রজাদের চোখ উপড়ে ফেলার রেওয়াজ আছে।মহারাজ বীরবল আজ পর্যন্ত চারজন লোককে এই সাজা দিয়েছেন। প্রতিবারই নিপুণ ভাবে সাজা কার্যকর হয়েছে।
ওদিকে মণিকা বলছিল, ‘তোমার পানিশমেন্ট তো মাফ করে দেয়া হলো। এবার তাহলে আমাদেরকে একটা কবিতা শোনাও!’
ইশান নত মুখে কঠিন গলায় বলল, ‘এখন কবিতা মনে পড়ছে না।’
রাজকন্যার হাত ভর্তি নীল রঙের নীহারিকা ফুল গচ্ছিত ছিল। সে একটি ফুল ইশানের দিকে তাক করে বলল, ‘কবিতা পড়ে শোনালে তোমাকে একটা ফুল উপহার দেব।’
'#oran_megher_deshe' '#উড়ান_মেঘের_দেশে'
'#bangla_story_143' '#banglastory143'
ইশান আগের মতোই শক্ত গলায় বলল, ‘আমার ফুল চাই না।’
-’কেন? তোমার নীহারিকা ফুল পছন্দ নয়?’
ইশান এবার চোখ তুলে তাকাল রাজকন্যার দিকে। ওই টুলটুলে পুতুল পুতুল আদুরে মুখটার ওপর স্থির দৃষ্টি স্থাপন করে বলল, ‘এতদিন পছন্দ ছিল। এখন আর নেই!’
অপমানে বুকটা ছ্যাঁত করে ওঠে নীহারিকার। রাগী গলায় বলে, ‘কেন?’
ইশান চোখ নামায়। মৃদু স্বরে বলে, ‘ অহংকার ওর রুপের মাধুরি ধ্বংস করে দিয়েছে। তাই ...।’
ঠিক সেই সময় তিনজন প্রহরীর একটি দল দৃশ্যপটে উপস্থিত হলো সন্তর্পণে। কোন ভূমিকা ছাড়াই মুহূর্তের মধ্যে দুদিক থেকে জাপটে ধরে আটক করে ফেলল ইশানকে। নীহারিকা চেঁচিয়ে উঠে বলল, ‘কী ব্যাপার? কোথায় নিয়ে যাচ্ছেন ওকে?’
একজন প্রহরী গম্ভীর কণ্ঠে উত্তর দিল, ‘মহারাজের আদেশ।’
নীহারিকার আত্মা শুকিয়ে গেলো ভয়ে, ‘কিন্তু কেন? ও কী দোষ করেছে?’
প্রহরীদের কেউ কোনও উত্তর দিল না। ভীত, শঙ্কিত এবং কম্পিত ইশানকে টেনে হিঁচড়ে নিয়ে যেতে লাগল।
No comments