জাফরিন - পর্ব-১১ | Jafrin - Part-11
গল্প | #জাফরিন 💫
পর্ব | ১১
লেখক | আস্থা রাহমান শান্ত্বনা

রিফাত কাপতে কাপতে হাত জোড় করল অবয়বটার সামনে। তার নাক-চোখ দিয়ে অনবরত ফোটা ফোটা রক্ত ঝরছে, এত জোরে জোরে কয়েকবার তাকে আছাড় মারা হয়েছে যে শরীরের একটা অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ নড়াতে পারছেনা। আধখোলা প্যান্টটা রক্তে ভিজে আছে, যেটুকু সম্বল ছিল তাও কেটে দেওয়া হয়েছে। ব্যথায় মনে হচ্ছে আজ সে মরেই যাবে। অবয়বটা হাসিতে ফেটে পড়তে পড়তে বলল,
"আগেই বলেছিলাম, আমার ভয়ংকর রুপ তোকে নিমিষেই শেষ করে দিতে পারে। কাউকে ছাড়ব না আমি।"
#জাফরিন_পর্ব_১১
#jafrin_part_11
#https://banglastory143.blogspot.com/
রিফাতের দম যেন বন্ধ হয়ে আসছে, মেঝেতেই মরার মত পড়ে রইল সে।
পিছনে কারো উপস্থিতি টের পেয়ে আহিন নড়েচড়ে পিছনে ফিরে তাকাল। শূণ্যছাদে আর কাউকেই দেখতে পেলনা সে। তবুও মনে আশার সঞ্চার হল জাফরিন ফিরে আসেনি তো। কিছু বুঝে উঠার আগেই তাকে শুণ্যে তুলে জোরে আছাড় দেওয়া হল।
আছাড় খেয়ে সে একটুর জন্য নিচে না পড়ে ছাদের কার্ণিশে আটকে ঝুলে রইল। তখন ই তার সামনে দৃশ্যমান হল বিরাট আকৃতি এক অবয়ব।
আহিন ভয় পেয়ে ভালো করে তাকাল। অবয়বের চোখ দুটো আগুনের গোলার মত, দৃষ্টি দিয়ে ভস্ম করে দেওয়ার মত, সোনালী বর্ণের চুলগুলো তীরের ফলার মত সুক্ষ্ম।
বাতাসে বারবার নড়ে উঠছে, পরনে মোটা কালো জোব্বা। এত ভয়াবহ চেহারা দেখেও আহিনের চিনতে দেরী হলনা এই তার জাফরিন।
এত ব্যথার মধ্যেও তার মুখে হাসি ফুটে উঠল, চোখ দুটো খুশিতে টলমল করছে। কিছু বলার আগে জাফরিন তার গলা চেপে শুণ্যে উড়িয়ে অন্য একটা নির্জন জায়গায় নিয়ে এল।
আহিনের কষ্ট হচ্ছে, এত জোরে আগে কখনো জাফরিন তার গলা চেপে ধরেনি। এক্ষুনি যেন রুহটা তার গলা দিয়েই বের করে আনবে। অবয়বটা নির্জন জায়গায় এনে মাটিতে ছুড়ে মারল আহিনকে।
আহিন সেইভাবেই পড়ে রইল, একবিন্দু জোর পাচ্ছেনা উঠে বসার। এদিকে তার ঠোট ফেটে রক্ত ঝরছে। আহিন ঘাড়টা ঘুরিয়ে চারিদিকে তাকাল, এখানে ঘন বাশঝাড় ছাড়া আর কিছুই চোখে পড়ছে।
পরে সে জায়গাটা চিনতে পারল, এটাই সেই পুরোনো পরিত্যক্ত কবরস্থান যেখানে সে পরশুদিন রিফাতসহ এসে আগুন জ্বালিয়েছিল।
আহিন অসহায়চোখে জাফরিনের দিকে তাকাল। পাশেই বড় একটা আগুনের গোলা জ্বলছে, জাফরিন সেটার দিকে তাকিয়ে আছে। আহিন কাপাগলায় বলল, "জাফরিন আমি জানতাম তুমি ফিরে আসবে।"
কথাটা শুনে জাফরিন রাগমিশ্রিত চাহনীতে আহিনের দিকে তাকাল, তারপর অট্টহাসিতে ফেটে পড়ে বলল,
"তুই তাহলে জানতিস তোর মৃত্যুদূত আসবে!"
#জাফরিন_পর্ব_১১
#jafrin_part_11
#https://banglastory143.blogspot.com/
আহিন কিছু বলার আগে জাফরিন আবার বলতে লাগল, "আমাকে তুই আগুনে পুড়িয়ে মারতে চেয়েছিস না! আজ তোকে এই গোলার মধ্যে ফেলে আমি পুড়িয়ে মারব। তখন বুঝবি মৃত্যুযন্ত্রণা কতটা কষ্টের হয়।"
আহিন অবাক হয়ে গেল জাফরিনের কথা শুনে। সে ঠিক বুঝতে পারছেনা, জাফরিন এসব কি বলছে।
"আমি তোমাকে মারতে চেয়েছি! এসব কি বলছো?"
"চালাকি করছিস আমার সাথে! তোর কোনো চালাকি ই আজ খাটবেনা।
আমি কি তোর কোনো ক্ষতি করেছি নাকি তোর পরিবারের করেছি! তাও তোর এত ক্ষোভ আমার উপর। একটা ভুল তো আমি ঠিক ই করেছি, তোর মত একজনকে নিয়ে সারাজীবন সংসার করতে চেয়েছি।
কিন্তু আমি চলেও যেতে চেয়েছি, তুই আমাকে বার বার আটকেছিস। তোর মনের কথাগুলো বুঝে আমি তোর কাছে থেকে গেছি, এই ভেবে তুই আমাকে চাস।
কিন্তু আমি ভুল করেছি।"
আহিনের মনে হল, জাফরিন কোনোকিছু তাকে ভুল বুঝে আছে। এই ভুল ভাঙ্গানোটা প্রয়োজন।
"জাফরিন তুমি একটুও ভুল করোনি। তুমি জানো, আমি কত আশা নিয়ে সেইরাতে রজনীগন্ধা নিয়েই ফিরেছিলাম। কিন্তু এসে তোমাকে পেলামনা।"
"চুপ কর বেঈমান। তোরা মানুষরা আসলেই খারাপ, আজ বুঝলাম আমরা এমনি এমনি তোদের ক্ষতি করতে আসিনা। তোদের মত অজাত বেঁচে আছে বলেই আমরা স্বাভাবিক জীবনযাপন করতে পারিনা। নিজের পরিবারকে কাছে পাইনা।" বলে জাফরিন দুহাতে মুখ ঢেকে কাঁদতে লাগল।
আহিন ঠিক কি বলে জাফরিনকে বুঝাবে বুঝতে পারছেনা। তার শুধু মনে হচ্ছে আজ যদি জাফরিনকে কিছু বলতে না পারে, সারাজীবনেও পারবেনা। জাফরিন আজ তার ভয়ংকর আসল রূপ নিয়ে এসেছে, হয়ত আহিনকে মেরেই সে শান্ত হবে।
আহিনের মরতে আফসোস নেই, জাফরিনকে তো আর সে কম কষ্ট দেয়নি।
"জাফরিন আমি তোমাকে কিছু বলতে চাই।"
#জাফরিন_পর্ব_১১
#jafrin_part_11
#https://banglastory143.blogspot.com/
"তোর কোনো কথার ফাদে আমি পড়তে চাইনা, তোরা মানুষরা দূর্বলতার সুযোগকে খুব ভাল ই কাজে লাগাস। আজ তোকে আমি সেটা করতে দিবনা। তোকে এই আগুনের গোলায় ফেলেই পুড়িয়ে মারব।"
বলে আহিনকে উপরে তুলে নিয়ে বলের মত আগুনের গোলার মাঝে ছুড়ে দিল জাফরিন।
জাফরিনের চোখ বারবার ঝাপসা হয়ে আসছে। একজন মানুষের জন্য তার গোত্রের কেউ এভাবে চোখের পানি ফেলেছে কিনা তার জানা নেই।
আফসোস আর কষ্ট দুটো ই হচ্ছে তার, ইসস! যদি সে আহিনের কাছে কখনো না আসত। আহিনের পিঠের খানিকটা আগুনের আচে পুড়ে গেছে, সেই ক্ষতস্থানে জাফরিন হাত বুলাতে বুলাতে কাদছে। সে পারেনি আহিনকে পুড়িয়ে মারতে।
কেমন এক অজানা মায়া তাকে গ্রাস করেছিল, আবেগের কাছে তার বিবেক হার মেনে গেল। আগুনে পড়ার আগেই সে আহিনকে তুলে নিয়ে আসে। রাগের চেয়ে ভালোবাসার শক্তি আসলেই অনেক বেশী।
আয়শা খানম এসে দরজায় নক করে। জাফরিন তাড়াতাড়ি চোখ মুছে চাদরটা আহিনের ঘাড় অবধি টেনে দরজা খুলে।
আয়শা খানম জাফরিন কে বুকে টেনে দু গালে চুমু খেয়ে বলে, "স্বামীর উপর রাগ করে সংসার ছেড়ে যেতে আছে পাগলী মেয়ে!"
জাফরিন থ হয়ে আয়শা খানমের বুকের কাছে পড়ে রইল। সবাই কেন তার আফসোস বাড়াচ্ছে! এই মমতাময়ীকে একদিন সে ছাদ থেকে ফেলে মারতে চেয়েছিল। কিন্তু এই মহিলা সব ভুলে গিয়ে তাকে নিজের মেয়ের মত আপন করে নিয়েছেন।
এরমধ্যে অহনা বড় এক আচারের বোয়াম হাতে করে এনে বলে, "ভাবী দেখো তোমার জন্য আমি আচার বানিয়ে রেখেছি। ১ ঘন্টায় খেয়ে শেষ করো তো দেখি!"
#জাফরিন_পর্ব_১১
#jafrin_part_11
#https://banglastory143.blogspot.com/
তারপর জাফরিনের হাতটা চেপে ধরে বলল,
"দোহাই তোমার আমার পাগল ভাইটা যাই বলুক, এভাবে রাগ করে আর কখনো যেয়োনা ভাবী।"
জাফরিনের ভীষণ কাঁদতে ইচ্ছে হচ্ছে। এত ভালোবাসার ঋণ শোধ করার ক্ষমতা তার সত্যিই নেই। এরা তাকে কখনো তার আসল রূপ ব্যবহার করতে দিবেনা, তার যত খারাপি থাকুক না কেন এই ভালোবাসায় সবটা মিহিয়ে যাবে।
আহিন জাফরিনকে চুপ করে বসে থাকতে দেখে বলল,
"মারোনি আমায়?"
জাফরিন পা দোলাতে দোলাতে আচারের গোটা চুষতে চুষতে বলল, "তোকে মারলে জ্বালাতাম কাকে!"
আহিন এক লাফে উঠে এসে জাফরিনকে ধরে বলল,
"তাহলে সত্যিটার থেকে পালিয়ে বেড়াচ্ছো কেন?"
"আমার সত্যিটা এর থেকেও বেশী ভয়ংকর। আমি এসেছিলাম, তোদের পরিবারের ক্ষতি করতে। তোদের পরিবারের উপর কেউ কুনজর ফেলেছে, সেই কারণে এক তান্ত্রিক আমাকে পাঠিয়েছে অল্প অল্প যন্ত্রণা দিয়ে তোদের শেষ করতে।"
"তার কথা কেন শুনেছো?"
"আমি সেই ১০ বছর বয়স থেকে তার হাতে বন্দি। আমার মত অনেকেই তার হাতে বন্দি। তারা ও আমার মত জানেনা, তাদের মা-বাবা কে! আমাদের কাজ শুধু তার হুকুম তালিম করা, আমাদেরকে বশ করে যত খারাপ কাজ আছে সব করতে বাধ্য করেছে। কথা না শুনলে তার পালিত জ্বীন দিয়ে শারীরিক অত্যাচার করত কিংবা মেরে ফেলত।
চাবুকের বাড়ি এক একটা চামড়া ভেদ করে মাংসে ডেবে যেত।"
কথাগুলো শুনে আহিনের শরীরের পশম দাঁড়িয়ে যায়।
"আমার মাঝে মাঝে মনে হয়, আমি কোনো খারাপ পরী নই। আমাকে যেমন ভাবে চালনা করা হয়েছে, যে পরিবেশে ছিলাম আমি ঠিক তেমন ই হয়েছি।"
"ক্ষতি করতে এসেও করোনি কেন!"
#জাফরিন_পর্ব_১১
#jafrin_part_11
#https://banglastory143.blogspot.com/
"পারিনি আমি। যাকে কালিমা পড়ে বিয়ে করেছি তার ক্ষতি করতে মন সায় দেয়নি। তবে তান্ত্রিক আমাকে একা পাঠায়নি, সাথে আরেকটা জঘন্য জ্বীনকেও পাঠিয়েছিল। যে তোমার বোন অহনার গোসলের সময় তার নগ্ন শরীর দেখে তার সাথে সঙ্গম করতে চেয়েছিল। এইজন্য আমি অহনাকে বারবার নগ্ন হয়ে গোসল করতে বারণ করেছিলাম, তার বাচ্চা মন এসব আমলে নেয়নি। তাই সেদিন বাধ্য হয়ে শাসন করেছিলাম।
তোমার মাকেও আমি ফেলিনি, সেই জ্বীন আমার শরীরের রন্ধে প্রবেশ করে এসব করেছে।"
"সেদিন রাতে তোমার কি হয়েছিল?"
"পূর্ণ চাদের আলোয় আমাদের শক্তি বৃদ্ধি পায়। তখন আমরা শক্তি শূণ্য থাকি। আমি আচ করতে পেরেছিলাম এই সময় তান্ত্রিক বা জ্বীন আমার উপর হামলা করতে পারে তাই তোকে বলেছি সেখানে থাকতে। কিন্তু তুই চলে গেলি, সেই সুযোগে ওরা আমাকে চাবুক দিয়ে আঘাত করে।"
আহিনের কথাটা শুনে খুব খারাপ লাগছে। কতবড় ভুল টাই না করেছিল সে!
"আমি এখন আর তোদের সাথে থাকতে চাচ্ছিনা। একজন খারাপ পরীর সাথে আজীবন তোর কাটানো ঠিক হবেনা, আমাকে তালাক দিয়ে দে তুই।"
আহিন জাফরিনের মুখটা চেপে ধরে বলল, "এটা কখনোই হবেনা। আমাকে সারাজীবন জ্বালানোর দায়িত্বটা তোমায় নিতেই হবে। বিনিময়ে তুমি খারাপ জিনিস গুলো ত্যাগ করো।"
"কিন্তু তোর পরিবার?"
"কেউ এসব কখনোই জানবেনা।"
জাফরিন আর কিছু বলতে পারেনা, আহিনের বুকে মাথা ঠেকে কান্নায় ভেঙ্গে পড়ে। আহিন আস্তে আস্তে জাফরিনের চুলে বিলি কেটে যায়। জাফরিন একটু চুপ থেকে খিলখিলিয়ে হেসে বলে,
"আমাকে শেষবারের মত বকরী এনে খাওয়াবি?"
আহিনের শরীর গুলিয়ে উঠে, পানসে মুখ করে বলে,
"আবার!"
#জাফরিন_পর্ব_১১
#jafrin_part_11
#https://banglastory143.blogspot.com/
"হ্যা, এবার দুজনে একসাথে গাছে বসে খাব কেমন!"
কথাটা শুনে আহিনের মাথা ঘুরতে থাকে। জাফরিন কাধের উপর পড়ে ওয়াক ওয়াক করতে থাকে। আর জাফরিন খিলখিল করে হাসতে থাকে।
🔰 🔰 🔰 চলবে 🔰 🔰 🔰
No comments